Kudrate Jahan
Author, Bookworm, Cinephile, Cricfreak
Author, Bookworm, Cinephile, Cricfreak
রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে আকাশ থেকে আছড়ে পড়লো এক মহাকাশযান। কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে এলো চটচটে কুৎসিত এক জৈবিক পদার্থ, যাকে দেখে ঘৃণা লাগলেও খুব ক্ষতিকর কিছু বলে মনে হয় না। কিন্তু মানুষের সাথে মিলে গিয়ে সেই অদ্ভুত জীবটি জন্ম দিতে পারে এমন এক অতিমানবের, যাকে দমন করা অসম্ভবপ্রায়।
বলছিলাম মার্ভেল কমিকের জনপ্রিয় ভিলেন চরিত্র সিম্বিওটদের কথা। অন্ধকারের দেবতা নাল নিজের অসীম ক্ষমতায় সৃষ্টি করেছে এই সিম্বিওটদেরকে, দেবতাদের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য। তাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে হার মানলেও পরে এদের মিথোজীবীতাকে পুঁজি করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দখল করে নেবার পরিকল্পনা করে নাল।
মার্ভেলের কমিকে প্রথম এর আবির্ভাব ঘটে ১৯৮৪ সালে, অ্যামেজিং স্পাইডারম্যানের ২৫২ তম ইস্যুতে। স্পাইডারম্যান তথা পিটার পার্কারের দুঃসময়ে তার সাথে জোট বাঁধে এক সিম্বিওট। প্রথমে এর সাহায্যে নানা দিক দিয়ে ক্ষমতা বেড়ে যায় পিটারের, কিন্তু কিছুদিন পরেই ভেনমের প্রভাবে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করা শুরু করে সে। অবশেষে সিম্বিওটের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পিটার এর প্রভাবমুক্ত হয়। কিন্তু ততদিনে পিটারের ওপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল সিম্বিওটটি। পরে সাংবাদিক এডি ব্রকের সাথে জোট বাঁধে সে। পিটারের ওপর অসন্তোষ ছিল দুজনেরই, একে কাজে লাগিয়ে তারা পরিণত হয় স্পাইডারম্যানের অন্যতম বিখ্যাত ভিলেনে, যার নাম ভেনম।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ভেনমের অরিজিন স্টোরি স্পাইডারম্যানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু মার্ভেলের সাথে চুক্তির ফলে স্পাইডারম্যানকে ভেনমের স্ট্যান্ডঅ্যালোন মুভিতে আনতে পারলো না সনি। একের পর এক দুর্দান্ত সুপারহিরো মুভি উপহার পাওয়া দর্শকদের মন জয় করা এমনিতেই কঠিন ব্যাপার। তার ওপর মুক্তির আগে আগে ‘ভেনম‘ অভিনেতা টম হার্ডি মুখ ফসকে বলে দেন, মুভিটিকে আর-রেটেড থেকে পিজি-১৩ করার উদ্দেশ্যে নাকি তার পছন্দের ৪০ মিনিটের দৃশ্য কেটে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে এসবের কোনো কিছুই মুভিটির সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সাম্প্রতিককালের আলোচিত এই মুভিটিকে নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
ব্যস্ত সাংবাদিক এডি ব্রক একদিন বাগদত্তার কম্পিউটারে মানুষ গবেষণার কিছু ক্লাসিফায়েড তথ্য আবিষ্কার করেন। কিছুটা মাথা গরম করেই সরাসরি গিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসেন লাইফ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার কার্লটন ড্রেককে। এডি নাড়া দিয়েছিলেন কিন্তু আসল জায়গাতেই, এই কার্লটন ড্রেকই মহাকাশে প্রোব পাঠিয়ে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন অশুভ সিম্বিওটদের। পরিণামে এডির জীবন এককথায় ছারখার করে দেন মহা প্রভাবশালী ড্রেক। কিছু অসহায় মানুষকে চিকিৎসার নামে গিনিপিগ বানিয়ে তাদের ওপর নিষ্ঠুর গবেষণা চালাতে থাকে লাইফ ফাউন্ডেশনের গবেষকেরা।
চাকরি খোয়ালেও নিজের অনুসন্ধিৎসু মন একদিন এডিকে টেনে নিয়ে যায় লাইফ ফাউন্ডেশনে। অবশ্যম্ভাবীভাবেই সেখানে থাকা সিম্বিওটগুলোর একজন ভর করে এডির ওপরে। অস্বাভাবিক কিছু ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান এডি, তবে নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভেনমের সাথে ক্রমাগত অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকে তার। এদিকে কার্লটন ড্রেকও কিন্তু বসে নেই। ভেনমকে খুঁজে বের করার জন্য ঠিকই আঁটঘাঁট বেঁধে এডির পিছে লাগেন ড্রেক।
নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতার সময়ে ভেনমকে প্যারাসাইট বলে সম্বোধন করায় এডির ওপর ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয় ভেনম। আর রাগ হবার কারণ আছেও বৈ কি। ভেনম হলো সিম্বিওট তথা মিথোজীবী। জীববিদ্যার খটরমটর ভাষায় বোঝাতে গেলে, বেঁচে থাকার জন্য সিম্বিওট এবং তার হোস্ট একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এডির ওপর ভর করে ভেনম যেমন নিজের একটা পরিচয় খুঁজে পায় , তেমনি ভেনমের সাহায্যে অস্বাভাবিক সব ক্ষমতার অধিকারী হয়ে সুপারহিরোতে পরিণত হন এডি।
সেই ১৯৯৭ সালেই ভেনমের স্ট্যান্ডঅ্যালোন মুভি বানাবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর দশ বছর পরে স্যাম রাইমির ব্যাপক জনপ্রিয় স্পাইডারম্যান ট্রিলজির তৃতীয় কিস্তি দিয়ে প্রথম অনস্ক্রিনে আসে ভেনম। সেখানে টফার গ্রেসের করা ভেনম চরিত্রটি আশানুরূপ সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়। ২০০৯ সালে ভেনমের বেশ কয়েকটি স্ক্রিপ্ট লেখা হলেও সনি সেগুলোতে তেমন একটা সাড়া দেয়নি। পরে ঠিক হয়, ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া দ্য অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান মুভির চতুর্থ পর্বে ভেনমকে আনা হবে। ২০১৫ সালে মার্ভেল কোম্পানি স্পাইডারম্যান চরিত্রটির সত্ত্ব সনির কাছ থেকে কিনে নেয়। ফলে সনি সিদ্ধান্ত নেয়, স্পাইডারম্যানকে ছাড়াই ভেনমকে বড় পর্দায় আনবে। এ কারণেই মুভিতে কমিকের মতো ভেনমের বুকে কোনো সাদা মাকড়সা আঁকা ছিল না।
যারা স্পাইডারম্যান কমিক কিংবা স্পাইডারম্যান ৩ মুভির কথা জানেন, তারা ভেনমকে ভিলেন হিসেবেই চেনেন। এডি ব্রককেও খুব বেশি ভালো মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি কোথাও। পিটার পার্কারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিংসুটে এডি কখনোই কারো প্রিয় চরিত্র ছিল না। কিন্তু এখানে কমিক থেকে সরে এসে সেই এডিকেই সবার প্রিয়পাত্র করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এখনকার সময়ের একজন প্রতিভাবান অভিনেতা টম হার্ডি যে সেই ভূমিকায় শতভাগ সফল, তা দর্শক ‘ভেনম’ দেখামাত্রই টের পাবেন।
মুভির সেরা দিক নিঃসন্দেহে ভেনম এবং এডির কথোপকথন। বিভিন্ন সময়ে ভেনমের ট্রান্সফর্মেশন এবং অ্যাকশন দৃশ্যগুলোও দুর্দান্ত ছিল। ‘ভেনম’ আক্ষরিক অর্থেই টম হার্ডির ওয়ান ম্যান শো। এমনকি ভেনমের কণ্ঠ এবং মোশন ক্যাপচারের কাজটিও তিনিই করেছেন। কাহিনী খুব জটিল ছিল না, কিন্তু খুব দ্রুত এগিয়েছে। ‘জম্বিল্যান্ড’ খ্যাত পরিচালক রুবেন ফিশার অ্যাকশন এবং কমেডির মধ্যে ভালোই ভারসাম্য রাখতে পেরেছেন। পিজি-১৩ করতে গিয়ে এর ভায়োলেন্স যে বেশ কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে বোঝা যায়, তবে তাতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি। এমিনেমের সাউন্ডট্র্যাক মুভিতে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে।
আরেক ক্ষেত্রে মুভিটি অনন্য হয়ে থাকবে। কিছুদিন আগেই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া মার্ভেলের কর্ণধার স্ট্যান লির জীবিতাবস্থায় শেষ ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্স ছিল এই মুভিতেই। অবশ্য এর পরেও তাকে মার্ভেল ইউনিভার্সের বিভিন্ন মুভিতে দেখা যাবে, সেগুলো আগেই শ্যুট করে রাখা হয়েছে বলে।
তবে মুভিটি পিছিয়ে আছে বিভিন্ন দিক দিয়ে। ‘অ্যা নাইট অফ’ দিয়ে এমি জয় করে নেয়া শক্তিশালী অভিনেতা রিজ আহমেদকে তেমন একটা কাজে লাগাতে পারেননি লেখক, একাধিকবার অস্কারের জন্য মনোনীত মিশেল উইলিয়ামসের চরিত্রটিও বিকশিত হয়নি। ভাগ্য ভালো সনির, হার্ডির শক্তিশালী পারফরম্যান্স না থাকলে ‘ভেনম’ এর মুখ থুবড়ে পড়া নিশ্চিত ছিল। সিম্বিওট যখন এডির সাথে বন্ডিং করে, তখন তার শারীরিক এবং মানসিক প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ। কিন্তু মুভির অন্য দুই মূল চরিত্রের সাথে বন্ডিং করার পরে তারা বেশ স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করতে থাকে। কাহিনীর একটি বড় অসামঞ্জস্যতা বলা যায় একে। মুভির শেষ অঙ্কে ভিলেন বনাম ভেনমের লড়াই তেমন নতুন কিছু উপহার দিতে পারেনি। বরং ‘দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক’ এর আরেকটি রিপ-অফ বলে মনে হয়েছে।
ভিলেনের উদ্দেশ্যও পরিষ্কার না। সিম্বিওট দিয়ে মানুষের ক্ষমতা বাড়ানো, কোনো কারণে পৃথিবী থাকার অযোগ্য হয়ে পড়লে অন্য গ্রহে আবাস গড়ার পরিকল্পনার কথা শোনা গেছে। কিন্তু এ জাতীয় কোনো উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের হাতে গোটা মানবজাতিকে ছেড়ে দেয়া কোনো কাজের কথা না। ভেনম নিজেই একজন ভিলেন/অ্যান্টি হিরো, তাই তার ভিলেন হওয়া উচিত ছিল আরো দুর্ধর্ষ। সিক্যুয়েলে ‘কার্নেজ’ চরিত্রটির আসার আভাস দেয়া হয়েছে, ভয়ানক সব কর্মকাণ্ডের কারণে যাকে মার্ভেলের ‘জোকার’ বলা হয়। মুভিটি যদি আর-রেটেড হয়, তাহলে একেবারে ষোলকলা পূরণ হবে।
মুক্তির আগে সমালোচকদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার তোড়ে বড় একটি ধাক্কা খায় ভেনম। সমালোচকেরা একে হতাশ করা কমিক মুভি ‘ডেয়ারডেভিল’ আর ‘ক্যাটওম্যান’ এর সাথে তুলনা করা শুরু করেন। রোটেন টমাটোজ ওয়েবসাইটে মুভিটির রেটিং এক ধাক্কায় নেমে যায় ৩০% এ। এত কিছুর পরেও ভেনম বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে, দর্শকেরাও সমালোচকদের গ্রাহ্য না করে বেশ ইতিবাচক সাড়া দেন। মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের মুভিটির বিশ্বব্যাপী আয় এখন পর্যন্ত ৮০০ মিলিয়ন ছুঁইছুঁই করছে। আইএমডিবিতেও এর স্কোর নেহাত কম না, ৭/১০। মুভি রিলিজের সময়টাও এর সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। এর কাছাকাছি সময়ে কোনো বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি কিংবা সুপারহিরো মুভি মুক্তি পায়নি, পেলেও সেগুলো ফার্স্ট ম্যান, এ স্টার ইজ বর্ন, নান, হ্যালোউইনের মতো ভিন্ন জনরার।
মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের অংশ না হয়েও ভেনম কোনো অংশে কম যাচ্ছে না। স্পাইডারম্যানকে ছাড়াই স্পাইডারম্যান মুভিগুলোর কাছাকাছি ব্যবসা করে ভেনম দেখিয়ে দিয়েছে যে, সে আসলেই ‘পরজীবী’ নয়। দুর্ভাগ্য দর্শকদের, টম হার্ডি আর টম হল্যান্ডকে একইসাথে দেখার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে ইতিমধ্যেই ভেনমের ট্রিলজি আসার কথা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। সামনের মুভিগুলোতে কেবল এডি ব্রক নয়, আশেপাশের চরিত্রগুলোকেও কিছুটা বিকশিত হবার সুযোগ দেয়া হবে, এটাই ভক্তদের প্রত্যাশা।
কমিকের ভেনম সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য: