দেহের প্রায় সকল কোষেই ঘটে মিউটেশন- বলছে নতুন গবেষণা

সাধারণ কোষ এবং টিস্যুর মধ্যেও মিউটেশন ঘটে, এরকমটাই উঠে এসেছে এমআইটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ব্রড ইনস্টিউট থেকে সম্প্রতি করা এক গবেষণায়। অথচ, সুস্থ মানবদেহের কোষের মধ্যে থাকা জিনগুলোকে একে অপরের কার্বন কপি বলেই এতদিন মনে করতেন বিজ্ঞানীরা।
    

কমিক বইয়ের এক্স-ম্যানদের কথা অনেকেরই জানা। জেনেটিক মিউটেশনের ফলে তাদের শরীরে সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ এক জিন, যার নাম এক্স-জিন। এর কারণেই তারা পেয়ে গেছে অতিমানবীয় সব ক্ষমতা। প্রফেসর চার্লস জ্যাভিয়ার, ম্যাগনেটো কিংবা জ্যঁ গ্রের মতো শক্তিশালী মিউট্যান্টদের শরীরে এমনভাবে মিউটেশন ঘটেছে, যা সাধারণ মানুষের দেহে ঘটা সম্ভব নয়। এছাড়াও ফিকশনাল মনস্টার মুভি গডজিলা-তে বিপুল তেজস্ক্রিয়তার ফলে সাধারণ কিছু প্রাণীকে মিউট্যান্ট দানবে পরিণত হতে দেখা যায়। 

এগুলো ফ্যান্টাসি কাহিনী। তবে জেনেটিক মিউটেশন দেহের স্থায়ী পরিবর্তনের পেছনে আসলেই ভূমিকা রাখে। এ কারণেই অনেকে জন্মগতভাবে প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। এরা অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যায়। প্রোটিয়াস সিনড্রোমের ফলে অনেকের শরীরের হাড়, চামড়া এবং টিস্যু অযাচিতভাবে বেড়ে ওঠে। এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফরমিসের ফলে অনেকের হাতের আঙুল বেড়ে পরিণত হয় গাছের গুঁড়ির মতো।

বিপুল তেজস্ক্রিয়তার ফলে বিকলাঙ্গ হবার বিষয়টি প্রায়ই চোখে পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, টিউমার ও ক্যান্সারের পেছনে মূল কারণ হলো কোষ বিভাজনের দায়িত্বে থাকা জিনগুলোর মধ্যে ঘটা মিউটেশন। মিউট্যান্ট কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হওয়া শুরু করে। 

ক্যান্সার কোষ; Image Source: Science Source

মানবদেহে কোষের মাঝে মিউটেশনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। চিকিৎসাবিদরা টিউমার কোষে অনেক আগেই মিউটেশনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। টিউমার ছাড়াও স্বাভাবিক কোষেও মিউটেশনের ঘটনা ঘটে। এতদিন বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল এরকম ঘটনা অল্প-স্বল্প পরিমাণে ঘটে। কিন্তু এমআইটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় চমক লাগার মতো তথ্য উঠে এসেছে। তাদের অনুসন্ধানে শতকরা ৯৫ শতাংশ সাধারণ কোষে মিউটেশনের জিন খুঁজে পেয়েছেন। অন্তত ৪০ শতাংশ কোষে একটি বড় আকারের মিউটেটেড প্যাচ পাওয়া গেছে। আর ৫ শতাংশ কোষে ৫টিরও বেশি মিউটেটেড প্যাচ পাওয়া গেছে। গত ৬ই জুন বিজ্ঞান জার্নাল সায়েন্স-এ তাদের গবেষণার ফলাফল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

একটিমাত্র নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে বিভাজিত হতে হতে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন কোষের সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ মানবদেহ। আমাদের দেহের কোষগুলো যেন মোজাইকের মতো, প্রায় প্রতিটির মাঝেই সূক্ষ্ম কিছু জেনেটিক পার্থক্য বিদ্যমান। 

এই গবেষণায় ৪৮৮ জন মানুষের কাছ থেকে ৬৭০০টিরও বেশি টিস্যুর স্যাম্পল নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ২৯ প্রকারের এই টিস্যুর স্যাম্পল নেওয়া হয়েছে মস্তিষ্ক, কিডনি, চামড়া, স্তন এমনকি প্রোস্টেট থেকেও।

একই ধরনের মিউটেশন ঘটা কোষগুচ্ছকে বলা হয় লার্জ মিউটেশনাল ক্লোন। গবেষকরা আরএনএ সিকোয়েন্সিং ডাটা ব্যবহার করে স্যাম্পলগুলোর মধ্যে লার্জ মিউটেশনাল ক্লোনের খোঁজ করছিলেন। তারপর তারা এরকম ফলাফল পেয়ে হতবাক হয়ে যান। গবেষণার সাথে যুক্ত গবেষক কেরেন ইজহাক বলেন, “মানবদেহের বিভিন্ন টিস্যুর স্বাভাবিক কোষে জিন মিউটেশন নিয়ে এত বড় গবেষণা এটাই প্রথম।” 

স্টেম কোষ ; Image Source: CC0 Public Domain

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্যাথলজির প্রফেসর এবং ব্রড ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার জিনোম কম্পিউটেশনাল অ্যানালাইসিস গ্রুপের ডিরেক্টর গ্যাট গেটজ এই গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেছেন, “আদৌ কিছু খুঁজে পাব কি না, সেটাই জানতাম না। কিন্তু বলতে গেলে শরীরের প্রতিটা টিস্যুর মধ্যেই ম্যাক্রোস্কোপিক ক্লোন খুঁজে পেয়েছি আমরা। এগুলো কিন্তু ক্যান্সারাক্রান্ত টিস্যু নয়, নির্ভেজাল স্বাভাবিক টিস্যু। আমাদের গোটা শরীরটাইআসলে বড় একটা পাজলের মতো।”

অন্যান্য গবেষকেরা এর আগে এ ধরনের মিউটেশন বিশ্লেষণ করতেন ডিএনএ সিকোয়েন্সিং দ্বারা। গেটজ এবং দল এ কাজ করেছেন আরএনএ সিকোয়েন্সিং দ্বারা। তারা ডাটাসেট নিয়েছেন জিনোটাইপ টিস্যু এক্সপ্রেশন প্রোগ্রাম থেকে। এই প্রোগ্রামে ক্যান্সারে মারা যাওয়া মানুষদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বিপুল পরিমাণ টিস্যু সংরক্ষিত ছিল।

আরএনএতে মিউটেশন শনাক্ত করা বেশ জটিল কাজ। গবেষক দলের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়েছিল ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের উপযোগী করে। কেরেন ইজহাক ডিএনএ অ্যানালাইসিস টুল থেকে আরএনএর জন্য একটি পাইপলাইন তৈরি করেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘আরএনএ-মিউটেক্ট’। 

কোষগুচ্ছের মিউটেশন আমাদের শরীরে সেলুলার মোজাইক সৃষ্টি করে; Image Source: Science

গবেষকেরা দেখেছেন, চামড়া, ফুসফুস এবং অন্ননালীর কোষের মধ্যে মিউট্যান্ট প্যাচের পরিমাণ বেশি। কারণ, এই তিনটি অঙ্গ শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের তুলনায় পরিবেশ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। অর্থাৎ ধোঁয়া-ধূলা, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি কিংবা অন্যান্য পরিবেশগত কারণ থেকে বাঁচার জন্য এগুলোর মধ্যে মিউটেশন ঘটে।

এই গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত নন এমন দুজন প্যাথলজি প্রফেসর, স্কট কেনেডি এবং রোজানা রিসকেসের মতে, মানবদেহে মিউটেশন বোঝার ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। “এই প্রযুক্তি আসার আগে সাধারণ মানবকোষে মিউটেশনের অস্তিত্ব শনাক্ত সম্পর্কে আমাদের তেমন ধারণা ছিল না। এখন পদ্ধতিটি আমাদের হাতের নাগালে আসার ফলে সামনে এ নিয়ে আরো বিস্তৃত গবেষণার পথ খুলে গেছে।”

এই গবেষক দলের কাজ এখন পর্যন্ত ম্যাক্রোস্কোপিক ক্লোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেগুলোর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে আরএনএ ডাটাসেট সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু ছোট আকারের মিউটেশনাল ক্লোন কিংবা এক গুচ্ছ কোষের চেয়ে ছোট একক, একটামাত্র কোষ নিয়ে গবেষণার জন্য ডাটা সংগ্রহ করার সূক্ষ্ম পদ্ধতি পর্যন্ত এখনো যেতে পারেননি তারা।

এখন প্রশ্ন হলো, মিউটেশনের এই বিশেষ গবেষণা ক্যান্সারকে আগেভাগে শনাক্ত করার বেলার কেমন প্রভাব রাখবে?   

ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করার কারণে যে ব্লাড টেস্টগুলো করা হয়, সেগুলোর ফলাফল এই সাধারণ কোষের মিউটেশন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। ‘ব্লাড বায়োপসি’ নামের এক সম্ভাবনাময় নতুন পদ্ধতি দিয়ে রক্তের মধ্যে টিউমার কোষ থেকে খসে পড়া ডিএনএ খোঁজা হয়। যদি সাধারণ কোষ থেকে খসে পড়া ডিএনএর মাঝেও ক্যান্সার সম্পর্কিত মিউটেশন পাওয়া যায়, তাহলে কিন্তু এই পদ্ধতিটি দিয়ে সঠিক ফলাফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সেজন্য কোন টিস্যুটি ক্যান্সারে রূপ নেবে আর কোনট নেবে না, তাদের মাঝে পার্থক্যটি খুঁজে বের করতে হবে গবেষকদের। 

বামে ডক্টর ইয়োতাম ড্রায়ার এবং ডানে ডক্টর গ্যাড গেটজ ; Image Source: Weizman Institute of science

যুক্তরাষ্টের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট থেকে সম্প্রতি কোষের ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা নিয়ে বড় আকারের গবেষণার জন্য প্রি ক্যান্সার অ্যাটলাস খোলা হয়েছে। গেটজের মতে,

রোগীর শরীরে ক্যান্সার সম্পর্কিত কোনো মিউটেশন পেলেই তার ক্যান্সার হয়েছে, এমনটা আর ধরে নেওয়া যাবে না এখন থেকে। এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে সবাইকে। ডায়াগনিস্টিশিয়ান এবং ডাক্তারদেরকে মাথায় রাখতে হবে ব্যাপারটা। 

এই গবেষণার মাধ্যমে শুধু ক্যান্সার নয়, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস এমনকি বার্ধক্যজনিত অন্যান্য রোগ সম্পর্কেও গবেষণার দ্বার খুলে গেছে। কোষের মধ্যে থাকা সোমাটিক ক্লোনের এক্সপ্রেশন থেকে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটি আগেই জানতেন গবেষকেরা। বয়স বাড়ার কারণে কোন অসুখগুলো বাড়ছে, আর পরিবেশগত কারণে কোন অসুখগুলো হচ্ছে, সেগুলোও হয়তো ভবিষ্যতে আলাদা করে ফেলা সম্ভব হবে এবং সেসবের প্রতিকারেও নেওয়া যাবে ব্যবস্থা। এভাবে চলতে চলতে হয়তো একদিন আমরা মানবদেহের অনেক অনারোগ্য রোগের সমাধান জেনে যাব।

Leave a Reply