চিরতরুণ উইল স্মিথ

দমফাটানো কমেডি, জমজমাট অ্যাকশন থ্রিলার, কিংবা ‘দ্য পারস্যুইট অফ হ্যাপিনেস’ এর মতো চোখে পানি এনে দেওয়া ড্রামা; সর্বত্রই উইল স্মিথের সাবলীল বিচরণ। তার সঙ্গীতপ্রতিভারও কিন্তু কোনো কমতি নেই, র‍্যাপশিল্পী হিসেবে চারটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড ঠিকই ভরেছেন নিজের ঝুলিতে।

অভিনয় কারণে বহুল পরিচিত হলেও তাকে মানুষ মূলত সুপারস্টার হিসেবেই গণ্য করে। কিন্তু তিনি যে একজন কিংবদন্তী, সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। দমফাটানো কমেডি, জমজমাট অ্যাকশন থ্রিলার, কিংবা ‘দ্য পারস্যুইট অফ হ্যাপিনেস’ এর মতো অশ্রুসিক্ত করে দেওয়া ড্রামা; সর্বত্রই তার সাবলীল বিচরণ। ঝুলিতে আছে সেরা অভিনেতা হিসেবে জেতা অস্কারসহ আরো বহু পুরস্কার। তার সঙ্গীতপ্রতিভারও কমতি নেই, র‍্যাপশিল্পী হিসেবে ৪টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পুরেছেন নিজের ঝুলিতে। সবসময় হাসিখুশি থাকা মানুষ কিন্তু প্রয়োজনে সোজাসাপ্টা কথা বলতেও ছাড়েন না। উইল স্মিথের কথা বলছিলাম এতক্ষণ। 

শিশু উইল স্মিথ; Image Source: WIll Smith’s Instagram

১৯৬৮ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ায় জন্ম নেন উইল স্মিথ। তার পুরো নাম উইলার্ড ক্যারল স্মিথ জুনিয়র। তবে গালভরা এই নাম বাদ দিয়ে ওভারব্রুক হাইস্কুলের শিক্ষকেরা তাকে ডাকতেন ‘প্রিন্স’ কিংবা ‘প্রিন্স চার্মিং’ বলে। কারণ মুখের কথা আর দুষ্টু হাসি দিয়ে ভুলিয়ে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা ছিলো তার, কেউই তার ওপর রাগ করে থাকতে পারতো না বেশিক্ষণ।

ফিলাডেলফিয়ার যে অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন, সেখানে খ্রিস্টানদের পাশাপাশি ইহুদী আর মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজনও বসবাস করতেন। কট্টর ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে উঠেও দারুণ সংস্কৃতিমনা ছিলেন তিনি। একই স্কুলে পড়া ডিজে জেফরি টাউনসের সাথে দারুণ বনে যায় তার, শুরু করেন হিপহপ গান গাওয়া। তের বছর বয়সেই লম্বায় ছয় ফুট দুই ইঞ্চি হওয়ায় বয়সের তুলনায় কিছুটা বড়ই দেখাতো তাকে।

নিজের র‍্যাপ পারসোনার নাম দেন ‘ফ্রেশ প্রিন্স’। ১৯৮৬ সালে বেরোয় তাদের প্রথম গান ‘গার্লস অ্যাইন’ট অ্যানিথিং বাট ট্রাবল’। তাদের প্রথম অ্যালবামের নাম ছিল ‘রক দ্য হাউজ’। সেটি বিলবোর্ড শীর্ষ ২০০-তে জায়গা করে নেবার ফলে উইল স্মিথ একজন মিলিয়নিয়ার বনে যান। সেসময় তার বয়স ছিল সবে আঠারো!

উইল স্মিথ এবং ডিজে জেফরি; Image Source: Digital Spy

গান-বাজনার পাশাপাশি পড়াশোনাতেও মন ছিল ভালোই, ফলে স্যাট পরীক্ষায় বেশ ভালো স্কোর করেন। ছেলেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর আশায় তার মা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন বোস্টনের বিশ্বখ্যাত এমআইটির একটি প্রি-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামে। তার মা ক্যারোলিন ব্রাইট ছিলেন ফিলাডেলফিয়া স্কুল বোর্ডের একজন কর্মকর্তা। তাই সহজেই হয়তো এমআইটিতে ভর্তি হতে পারতেন। কিন্তু নিজের ইচ্ছা না থাকলে কী আর করা! পরের বছরেই তার দল সাড়া ফেলে দেয় ১৯৮৮ সালের রেকর্ড ভেঙে দেয়া গান ‘প্যারেন্টস জাস্ট ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড’ দিয়ে, জিতে নেন গ্র্যামি পুরস্কার। সেবছরেই প্রথম র‍্যাপ গানের ক্ষেত্রে গ্র্যামি দেবার রীতি চালু হয়েছিল।

প্ল্যাটিনাম সার্টিফিকেট পাওয়া গানের সাথে কমেডি মিউজিক ভিডিও দিয়ে নজর কাড়েন সবার। এর পরের অ্যালবামটি হাফ মিলিয়ন কপি বিক্রি করলেও আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি। স্মিথ তখন কিছুটা বিপাকে পড়ে যান। জনপ্রিয় সুপারস্টার হলেও দেনার ভারে জর্জরিত অবস্থা। সেসময় একটি পার্টিতে নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে টিভি প্রযোজক বেনি মেডিনার মন জয় করে নেন। তার এই র‍্যাপ পারসোনার আদলেই নির্মিত হয় এনবিসি চ্যানেলের সিটকম ‘দ্য ফ্রেশ প্রিন্স অফ বেল-এয়ার’। প্রথম কয়েক এপিসোডে অন্যদের ডায়লগের সময়ে তাকে মুখ নাড়াতে দেখা যায়। পরে স্মিথ স্বীকার করেছিলেন, উত্তেজনার বসে পুরো স্ক্রিপ্টই মুখস্থ করে ফেলেছিলেন তিনি! 

১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সিটকমটির ৬টি সিজন প্রচারিত হয়েছিল। ঋণ মেটানোর জন্য প্রথম তিন সিজনে নিজের আয়ের সত্তর ভাগ দিয়ে দিতে হতো ট্যাক্স কোম্পানিকে। তবে এ অবস্থা দ্রুতই কাটিয়ে ওঠেন তিনি, সিটকমটির শেষ সিজনের একজন এক্সিকিউটিভ প্রযোজকও ছিলেন স্মিথ। সিরিজ চলাকালীন বিয়ে করেন শিরি জ্যামপিনোকে। তিন বছর সংসার করার পর ১৯৯৫ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাদের। ট্রে স্মিথ নামে তাদের একটি ছেলেও জন্ম নেয় এই সময়ে।

‘ফ্রেশ প্রিন্স অফ বেল-এয়ার’ সিরিজের পোস্টার; Image Source: NBC

সিটকমটি চলার সময়েই ‘হোয়্যার দ্য ডে টেকস ইউ’ এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন তিনি। প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৯৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সিক্স ডিগ্রিজ অব সেপারেশন’ মুভিতে। তবে তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া মাইকেল বে‘র অ্যাকশন কমেডি ‘ব্যাড বয়েজ’। আরেক কমেডিয়ান মার্টিন লরেন্সের সাথে তার জুটি দারুণ জমে অনস্ক্রিনে। এর পরের বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ব্লকবাস্টার সায়েন্স ফিকশন অ্যাকশন মুভি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ এর মাধ্যমে স্মিথ ভালোভাবেই প্রথম সারির তারকাদের মধ্যে জায়গা করে নেন।

১৯৯৭ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গ প্রযোজিত সায়েন্স ফিকশন কমেডি ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ এ অভিনয় করে আরেকবার বক্স অফিসে সাড়া ফেলে দেন তিনি। খ্যাতনামা অভিনেতা টমি লি জোনসের অভিনীত গম্ভীর ‘এজেন্ট কে’ এর সাথে হাসিখুশি ‘এজেন্ট জে’ এর রসায়ন দারুণ উপভোগ করেন দর্শকেরা। অ্যালিয়েন কিংবা ইউএফও নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের রাখঢাক ছিলো নব্বই দশকের আলোচিত টপিকগুলোর একটা। তাকেই ব্যঙ্গ করে বানানো ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ এর দারুণ সফলতা এর ফ্র্যাঞ্চাইজি নির্মাণে সহায়তা করে।

শুধু তা-ই নয়, সেবছর গ্রীষ্মে ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ এর থিম সং দিয়ে নিজের একক সঙ্গীত ক্যারিয়ার শুরু করেন। নিজেও সেই সময়টাকে উপভোগ করছিলেন দারুণ। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

আঠাশ বছর বয়সে যেন হঠাৎ করেই অনেক ভালো হয়ে গিয়েছিলাম সবকিছুতে, এমনকি বিছানাতেও!

এজেন্ট কে এবং এজেন্ট জে; Image Source: Columbia Pictures

সেই বছরই বিয়ে করেন নিজের বর্তমান স্ত্রী অভিনেত্রী জাডা পিংকেটকে। পরের বছর জন্ম নেয় তাদের ছেলে জ্যাডেন স্মিথ। দুই বছর বাদে জন্ম নেয় তাদের মেয়ে উইলো। নয় বছর বয়সে একবার ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিলেন উইল। তার পনেরো বছর বয়সী বোন একথা শুনে সাথে সাথে বেজবল ব্যাট হাতে ছিনতাইকারীদের খুঁজতে বের হয়ে যান।

জাডা পিংকেট; Image Source: detoxtorehab.com

নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেবার ব্যাপারে এই ধরনের ভালোবাসা এবং সাহসিকতার খোঁজই করেছিলেন তিনি। তার মতে,

ছোটখাটো জাডার হয়তো দুইটা বেসবল ব্যাট লাগবে, কিন্তু আমাকে রক্ষা করতে ও কারো তোয়াক্কা করবে না।

জাডা পিংকেটের অ্যাকশন চরিত্রগুলো সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা অবশ্য এই ব্যাপারে একমতই হবেন। ১৯৯৮ সালে জেন হ্যাকম্যানের সাথে থ্রিলার ‘এনিমি অফ দ্য স্টেট’ এ অভিনয় করে দর্শকদেরকে আরেকটি ব্লকবাস্টার উপহার দেন। তবে এরপরে জীবনের একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বিশ্বখ্যাত সায়েন্স ফিকশন মুভি ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ এর ‘নিও’ চরিত্রটি করার প্রস্তাব পেলেও কাহিনীর আগামাথা কিছু না বুঝে ওয়েস্টার্ন মুভি ‘ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরে অবশ্য জানিয়েছেন, এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তার।

দ্য ম্যাট্রিক্স ট্রিলজি’তে কাজ করার মতো যথেষ্ট প্রজ্ঞা ছিল না আমার। আর কিয়ানুর কাজ দেখে যা বুঝলাম, আমি জীবনেও এই চরিত্র ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারতাম না।

মজার ব্যাপার, তার স্ত্রী জাডা ম্যাট্রিক্স ট্রিলজির দ্বিতীয় ও তৃতীয় মুভিতে অভিনয় করেন।

মোহাম্মদ আলীর ভূমিকায় উইল স্মিথ; Image Source: Columbia Pictures

বেশ কয়েকটি ব্লকবাস্টার মুভিতে অভিনয় করলেও কিছু একটার অভাব বোধ করছিলেন যেন। সেই অভাব মেটানোর সুযোগ এসে গেলো ২০০১ সালে। স্মিথ পেয়ে গেলেন বিশ্বখ্যাত বক্সার মোহাম্মদ আলীর ভূমিকায় অভিনয়ের সুবর্ণ সুযোগ। এই হেভিওয়েট বক্সারের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বিশাল প্রস্তুতি নিলেন এক বছর ধরে। সনি লিস্টন, জো ফ্র্যাজিয়ারের মতো বিখ্যাত বক্সারদের কাছে ট্রেনিং নিলেন, ওজন বাড়ালেন ৩৫ পাউন্ড। তার জীবনের সেরা পারফরম্যান্সটি দেন ‘আলী‘ মুভিতেই, পেয়ে যান প্রথম অস্কার মনোনয়ন।

এর আগে রহস্যময় ব্যাগার ভ্যান্সের ভূমিকায় অভিনয় করেন দ্য লিজেন্ড অফ ব্যাগার ভ্যান্স মুভিতে। তার সাথে আরো ছিলেন ম্যাট ডেমন এবং চার্লিজ থেরন। ২০০৩ সালে অভিনয় করেন ব্যবসাসফল ব্যাড বয়েজ এর সিক্যুয়েলে। এবারে দুই পুলিশ বন্ধুকে দেখা যায় মিয়ামিতে ড্রাগ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে। আইজাক আসিমভের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত সায়েন্স ফিকশন অ্যাকশন মুভি ‘আই, রোবট’ মুক্তি পায় ২০০৪ সালে। সেখানে মানুষকে সহায়তাকারী রোবটদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা এক গোয়েন্দা পুলিশের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি।

মায়া সফটওয়্যার ব্যবহার করে নির্মিত প্রথম দিককার মুভিগুলোর একটি হলো ‘আই, রোবট’, ঐ বছর অস্কারে বেস্ট ভিজুয়াল ইফেক্ট বিভাগে মনোনয়নও পায় মুভিটি। একই বছর অ্যানিমেটেড মুভি ‘শার্কটেল’ এ কণ্ঠ দেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, রবার্ট ডি নিরোদের সাথে।

‘আই, রোবট’ এর একটি দৃশ্যে উইল স্মিথ ; Image Source: 20th Century Fox

অ্যাকশন মুভি থেকে বিরতি নিয়ে ২০০৫ সালে ইভা ম্যান্ডেসের সাথে অভিনয় করেন ‘হিচ’ মুভিতে। কমেডি ঘরানার এই মুভিতে স্মিথকে একজন ডেটিং বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখা যায়, যিনি ক্লায়েন্টদের নারীমন জয়ের বিভিন্ন উপায় শেখান। একই বছর মুক্তি পায় তার আরেকটি অ্যালবাম ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’, সেটিও আগের মতোই টপচার্ট দখল করে নেয় বিভিন্ন দেশে।

‘আলী’র পর ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য পারস্যুইট অফ হ্যাপিনেস’ মুভিটির মাধ্যমে স্মিথ তার ভক্তদের আরেকটি সেরা পারফরম্যান্স উপহার দেন। জীবনে একের পর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া এক অসহায় বাবার ভূমিকায় অভিনয় করে পেয়ে যান দ্বিতীয় অস্কার মনোনয়ন। নিজের ছেলে জ্যাডেনের সাথে অভিনয় করে বাবা-ছেলের রসায়ন পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন অনায়াসে।

অনুপ্রেরণাদায়ক মুভি খুঁজতে গেলে ‘দ্য পারস্যুইট অফ হ্যাপিনেস’ ছাড়া সেই তালিকা অসম্পূর্ণ। মুভিতে দেখানো রুবিক’স কিউব সমাধান করার ব্যাপারটি কিন্তু নকল না, বাস্তবেও উইল স্মিথ ঘড়ি ধরে এরকম সমাধান করতে পারেন। পরে লাইভ টক শোতে ৫৫ সেকেন্ডেই একটি কম্বিনেশন সমাধান করে সবাইকে তার প্রমাণ দেন।

‘পারস্যুইট অফ হ্যাপিনেস’ মুভিতে উইল স্মিথ; Image Source: Columbia Pictures

২০০৭ সালে মুক্তি পায় তার ক্যারিয়ারের আরেকটি সুপরিচিত মুভি ‘আই অ্যাম লিজেন্ড’। ক্যান্সারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎই সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়ানক ভাইরাস। তার প্রাদুর্ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অধিকাংশ মানুষ। আক্রান্তরা পরিণত হয়েছে ‘ডার্ক সিকার’ এ, রাতের আঁধারে শিকারের খোঁজে বের হয় তারা।

কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ভাইরোলজিস্ট রবার্ট নেভিলকে এই ভাইরাস সংক্রমণ করেনি, সেজন্য নিজের রক্ত দিয়ে এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করেন একাকী রবার্ট নেভিল। চার্লটন হেস্টনের ‘দ্য ওমেগা ম্যান’ মুভির রিমেক এই মুভিতে স্মিথের দুর্দান্ত অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়।

আই অ্যাম লিজেন্ড মুভিতে ভাইরোলজিস্ট রবার্ট নেভিলের ভূমিকায় উইল স্মিথ; Image Source: otakukart.com

২০০৮ সালে চার্লিজ থেরনের সাথে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন সুপারহিরো মুভি ‘হ্যানকক’ এ। প্রচলিত ঘরানার অন্য সুপারহিরোদের থেকে একটু ভিন্ন এই হ্যানকক অতিমানবিক ক্ষমতা দিয়ে অনেককে বাঁচান ঠিকই, বদমেজাজ এবং খামখেয়ালিপনার কারণে সাধারণ মানুষের মন জয় করতে পারে না সে। তবে একজন বন্ধু এবং তার স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় হ্যানকক নিজেকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা শুরু করে। একই বছর ‘সেভেন পাউন্ডস’ নামে একটি ড্রামা মুভিতে অভিনয় করেন। অনুশোচনায় দগ্ধ একজন মানুষ কীভাবে নিজের প্রায়শ্চিত্তের পথ খুঁজে বের করেন, তাই নিয়ে মুভির কাহিনী এগিয়ে যায়।

২০০২ এর মেন ইন ব্ল্যাক টু থেকে শুরু করে ২০০৮ এর হ্যানকক পর্যন্ত টানা ৮টি মুভিতে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। একটানা এতগুলো একশো মিলিয়নের উপরে আয় করা মুভিতে কাজ করার রেকর্ড নেই আর কোনো অভিনেতার। বেশিরভাগ ব্লকবাস্টারই জুলাই মাসে মুক্তি পাওয়ার কারণে তার ডাক নাম হয়ে যায়, ’মিস্টার জুলাই’।

এরপর নিয়েছিলেন ছোট একটি বিরতি। তবে খুব বেশিদিন অপেক্ষায় রাখেননি দর্শকদের। ২০১২ সালে ফিরে আসেন ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ এর তৃতীয় কিস্তি নিয়ে। জশ ব্রোলিনের সাথে তার জুটিও ভালোই উপভোগ করেন দর্শকেরা। পরের বছর ছেলে জ্যাডেনকে নিয়ে নির্মাণ করেন পোস্ট অ্যাপোক্যালিপ্টিক সায়েন্স ফিকশন মুভি’ আফটার আর্থ’। বিশাল বাজেটের এই মুভিটি আশানুরূপ ব্যবসা করতে ব্যর্থ হয়। ‘দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার’ এর বিদঘুটে অ্যাডাপ্টেশন করার পর পরিচালক এম নাইট শ্যামালানের ভাবমূর্তি বেশ ভালোই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, তার সংশ্লিষ্ট থাকার ব্যাপারটিই ‘আফটার আর্থ’ এর এই ব্যর্থতার পেছনের কারণ মনে করেন অনেকে।

‘হ্যানকক’ মুভিতে উইল স্মিথ; Image Source: Columbia Pictures

ইতিমধ্যেই তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তি পেয়েছে ‘অ্যানি’, ‘দ্য কারাটে কিড’ মুভিগুলো। অ্যাকশন এবং ড্রামা মুভিতে সমান পারদর্শিতার কারণে সুপারহিরো মুভিগুলোতে তাকে নেবার কথা উঠে আসে বারবার। অবশেষে ডিসির ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ মুভিতে হিটম্যান ‘ডেডশট’ এর ভূমিকায় চূড়ান্ত করা হয় তাকে।

মজার ব্যাপার, স্ত্রী জাডাও ডিসির টিভি সিরিজ ‘গোথাম’ এর সাথে যুক্ত। ২০১৬তে মুক্তি পাওয়া সুইসাইড স্কোয়াড নানা কারণে সমালোচনার মুখোমুখি হলেও বক্স অফিস কাঁপিয়ে দেয়। মুভির সেরা অংশ হিসেবে উইল স্মিথ এবং মারগট রবির চরিত্রায়নের কথা বলেন প্রায় সবাই। বিশেষ করে ‘ব্ল্যাক স্কিনহেড’ গানের সাথে ডেডশটের দৃশ্যটিকে মুভির সেরা অংশের একটি অনায়াসেই বলা যায়।

মারগট রবির সাথে এর আগেও তাকে আরেকবার দেখা গিয়েছিল ‘ফোকাস’ মুভিতে। ২০১৫তে মুক্তি পাওয়া এই হাইস্ট কমেডি মুভিটিও দারুণ সফল হয়। ২০১৭ তে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় তার সায়েন্স ফিকশন ক্রাইম মুভি ‘ব্রাইট’। সেখানে পুলিশ অফিসার ড্যারিল ওয়ার্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেন উইল স্মিথ। মুভিতে এমন এক পৃথিবী দেখানো হয়েছে, যেখানে এলফের মতো বিভিন্ন মিথোলজিক্যাল প্রাণী মানুষের সাথে বসবাস করছে।

‘সুইসাইড স্কোয়াড’ মুভিতে মারগট রবির সাথে উইল স্মিথ ; Image Source: Warner Bros

একের পর এক অ্যাকশন মুভি করলেও ড্রামা করা বাদ দিয়েছেন এমনটা নয়। ২০১৫ এ মুক্তি পায় বায়োগ্রাফিক্যাল স্পোর্টস ড্রামা ‘কনকাশন’। ফুটবলারদের ব্রেইন ট্রমা নিয়ে কাজ করা বিখ্যাত ফরেনসিক প্যাথোলজিস্ট বেনেট ওমালুর ভূমিকায় নিখুঁত অভিনয় করে বাগিয়ে নেন আরেকটি গোল্ডেন গ্লোব মনোনয়ন। ২০১৬ এর কোল্যাটারাল বিউটি মুভিতে সন্তানহারা বাবার ভূমিকায় স্মিথের চরিত্রটি যথেষ্ট প্রশংসা কুড়ায়। এডওয়ার্ড নর্টন, কেট উইন্সলেটসহ আরো অনেকেই ছিলেন এই মুভিতে।

 ২০১৯ সালে গাই রিচির নির্মিত আলাদিনের লাইভ অ্যাকশন অ্যাডাপ্টেশনে অভিনয় করেন তিনি। এখানে আলাদিনের জিনির কাহিনীটাকে একটু ভিন্ন কিন্তু মজার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়। অনেকেই এই আইকনিক চরিত্রটিকে কীভাবে তুলে ধরা হবে, তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন। কিন্তু স্মিথ একেবারে ছক্কা হাঁকিয়ে দেন। কিছুদিন বাদেই মুক্তি পায় ব্যাড বয়েজ সিরিজের তৃতীয় কিস্তি। 

স্ত্রী জাডা পিংকেট, ছেলে জ্যাডেন এবং মেয়ে উইলোর সাথে উইল স্মিথ; Image Source: Zambia

২০২১ সালে তার অভিনয়জীবনের একটি স্মরণীয় সুযোগ আসে। বিশ্বখ্যাত টেনিস কিংবদন্তী ভেনাস এবং সেরেনা উইলিয়ামসের উত্থান নিয়ে নির্মিত ‘কিং রিচার্ড‘ মুভিতে তাদের বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেন স্মিথ। সত্তরের দশকে যখন বর্ণবাদের করাল থাবা থেকে বেঁচে চলাই কঠিন ছিল, সে সময়ে রিচার্ড উইলিয়ামস তার পরিবার থেকে দুই-দুইজন টেনিস সুপারস্টারের জন্ম দেন। শুরু থেকেই তাদের ব্যাপারে অনমনীয় ছিলেন তিনি, কেউ কখনোই তাকে তার পরিকল্পনা থেকে সরাতে পারেনি। এর আগে ‘দ্য পারস্যুইট অফ হ্যাপিনেস’ এবং ‘কোল্যাটরাল বিউটি’ মুভির দুই বাবার চরিত্রই ছিল আইকনিক। তারপরেও, হাসিখুশি সুপারস্টার হিসেবে চিরচেনা স্মিথের পক্ষে কোমল কিন্তু কাঠিন্যে ভরা এই চরিত্র ফুটিয়ে তোলা খুব সোজা ছিল না। কিন্তু মন-প্রাণ ঢেলে কাজ করলে সবই সম্ভব।

রিচার্ড উইলিয়ামসের ভূমিকায় উইল স্মিথ; Image Source: Warner Bros.

এর আগে ‘আলী’ এবং ‘দ্য পারস্যুইট অফ হ্যাপিনেস’ এর জন্য মনোনয়ন পেলেও সোনার মূর্তিটা অধরাই থেকে গিয়েছিল। অবশেষে প্রথম মনোনয়ন পাওয়ার ঠিক বিশ বছরের মাথায় অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেলেন তিনি। ক্রিটিকস চয়েজ এবং বাফটা অ্যাওয়ার্ড পাওয়ায় ব্যাপারটা অনেকখানি নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অস্কারের দিনে একটা ভজঘট পাকিয়ে গেল। 

স্ত্রী জাডার চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে অস্কারের উপস্থাপক ক্রিস রক একটি স্থূল রসিকতা করেছিলেন। ডলবি থিয়েটারের সবাইকে স্তম্ভিত করে স্মিথ সোজা গিয়ে থাপ্পড় হাঁকিয়ে আসেন রকের মুখে। এরপরে বিরতিতে তাকে শান্ত করেন অভিনেতা ডেনজেল ওয়াশিংটন এবং টাইলার পেরি। কিছুক্ষণ পরেই সেরা অভিনেতা বিভাগে ঘোষিত হয় তার নাম। পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠে অশ্রুসজল মুখে স্মিথ বলেন, “রিচার্ড উইলিয়ামস নিজেও তার পরিবারকে সবকিছু থেকে রক্ষা করার জন্য ভয়ানক বাড়াবাড়ি করতেন। আর আমিও এরকমভাবে ভালোবাসা দেখাতে চাই। শিল্প যে আসলে বাস্তবজীবনের প্রতিবিম্ব, তারই উদাহরণ এটা।”

এখন এমন একটা অবস্থা যে তার বহু আরাধ্য অস্কার পাওয়ার ঘটনাকে ছাড়িয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে এই ঘটনাটি!

সেরা অভিনেতার অস্কার হাতে উইল স্মিথ, Image Source: abc

ফ্যান্টাসি শো ‘বাফি দ্য ভ্যাম্পায়ার স্লেয়ার’ এবং তার স্পিন-অফ ‘অ্যাঞ্জেল‘ এর দারুণ ভক্ত হলেও কখনো কোনো মুভিতে ভ্যাম্পায়ারের ভূমিকায় অভিনয় করেননি তিনি। আর গথিক হরর কিংবা পিরিয়ড ড্রামা জনরার কোনো মুভিতে এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি তাকে। তবে কখনো যে দেখা যাবে না, তা না।

নিত্যদিনই নতুন নতুন আইডিয়া খেলে যার মাথায়, তাকে ঠেকিয়ে রাখে সাধ্য কার! ৪৯ বছর বয়সেও গেয়ে ফেলেন বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ এর থিম সং ‘লিভ ইট আপ’, এমনকি সমাপনী অনুষ্ঠানে লাখো দর্শকের সামনেও গেয়েও শুনিয়েছেন। মাত্র ক’দিন আগে নিজের আরেক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন ডেভ চ্যাপেলের শোতে প্রথমবারের মতো স্ট্যান্ড-আপ কমেডি করে। প্রথম শো হলে কী হবে, সেখানকার লোকজন হেসেই গড়াগড়ি খেয়েছে তার গল্প বলার ধরন দেখে।

জিমি কিমেল শোতে উইল স্মিথ; Image Source: JImmy Kimmel Show

মাঝেমধ্যে সেলিব্রিটি হওয়াটা ভালোই উপভোগ করেন উইল স্মিথ। এই তো কিছুদিন আগেই গাড়ির তেল ফুরিয়ে যাবার পরে তার খেয়াল হলো, সাথে ডলার কিংবা ক্রেডিট কার্ড কোনোটাই নেই। এদিক-সেদিক তাকিয়ে বছর তিরিশের এক যুবককে দেখে মনে হলো, সে হয়তো ‘ফ্রেশ প্রিন্স’ এর ভক্ত হলেও হতে পারে। তার কাছে যেতেই সে চিৎকার করে বলল, “উইল! একটা সেলফি তুলি তোমার সাথে?”। উইল বললেন, “অবশ্যই, তবে তার আগে আমাকে দশ ডলার ধার দিতে হবে।” পরে অবশ্য তিনি অনেক চাপাচাপি করেও ভক্তকে সেই টাকা ফেরত নেয়াতে পারেননি।

তিনি আরেক হলিউড সুপারস্টার টম ক্রুজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন, যদিও একসাথে কোনো মুভিতে দেখা যায়নি তাদের। ক্রুজের মতো না হলেও সায়েন্টোলজির কিছু রীতিনীতির ব্যাপারে স্মিথের সমর্থন আছে। তার প্রিয় মুভি ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’। ফোর্বসের মতে, বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ২৫০ মিলিয়ন ডলার। এ পর্যন্ত তার একক অ্যালবাম চারটি, ডিজে জেফরির সাথে যৌথ অ্যালবাম পাঁচটি।

দুই ছেলে ট্রে স্মিথ এবং জ্যাডেন স্মিথের সাথে উইল স্মিথ ; Image Source: Outpump

বড় বড় ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে জড়িত হয়েও হলিউডের এই মেগাস্টার সবাইকে আপন করে নিতে পারেন নিজের মতো। ‘হিরোজ’, ‘দিস ইজ আস’ খ্যাত অভিনেতা মিলো ভেনটিমিলিয়া কিশোর বয়সে গিয়েছিলেন ‘ফ্রেশ প্রিন্স অফ বেল এয়ার’ এর একটি ছোট চরিত্র করতে। তখনই বেশ বড় তারকা উইল স্মিথের সাথে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে কিছুটা ভয়েই ছিলেন মিলো। কিন্তু এত বড় তারকা হবার পরও স্মিথকে সেটের সবার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। তার মতে, স্মিথের এই আচরণ তাকে অভিনেতা হিসেবে উদার হতে শিখিয়েছে।

ক্রুদের সাথে তার আচরণ দেখে খুবই ভালো লেগেছিল। বিখ্যাত টিভি স্টার, মুভি স্টার কিংবা সুপারহিরো, যা-ই হোক না কেন; সবার আগে স্মিথ একজন সত্যিকারের বিনয়ী মানুষ।

বিশাল তারকাখ্যাতি কিংবা প্রাচুর্য কোনোটাই সেভাবে স্পর্শ করতে পারেনি উইল স্মিথকে। তিনি বরাবরই সেই একই মানুষ রয়ে গেছেন। তার খ্যাতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে আত্মবিশ্বাস। তার ধারণা, চেষ্টা করলে একদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্টও হয়ে যেতে পারেন! হলিউডে থেকেও কোনো বিতর্ক ছুঁতে পারেনি তাকে। উচ্ছ্বল এই মানুষটি কেবল তার মুভিগুলোর কারণে নয়, বরং তার ব্যাক্তিত্বের কারণেই সবার কাছে জনপ্রিয় থাকবেন বহুদিন, তার একজন ভক্ত হিসেবে এমনটি আশা করাই যায়।

 

Leave a Reply