দ্য ইনক্রেডিবলস ২: সুপারহিরো পরিবারের দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন

এতসব চোখধাঁধানো সিজিআই ইফেক্ট কিংবা টুইস্টওয়ালা কাহিনীর ভিড়েও যে ইনক্রেডিবল পরিবারের আবেদন একটুও কমেনি, তাই প্রমাণ করে দিলো ইনক্রেডিবলস ২

সেই ২০০৪ সালের কথা। তখন টয় স্টোরি, ফাইন্ডিং নিমো কিংবা শ্রেকের মধ্য দিয়ে হলিউডের অ্যানিমেশন মুভিগুলোর থ্রিডি প্রযুক্তি হাঁটি হাঁটি পা পা করে আগাচ্ছিল। স্পাইডারম্যান ২ কিংবা এক্স-ম্যানের মতো হাতে গোনা কয়েকটা ব্লকবাস্টার সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজি ছিল। সেই সময় মুক্তি পেয়েছিল সুপারহিরো অ্যানিমেশন মুভি দ্য ইনক্রেডিবলস। মিস্টার ইনক্রেডিবল, ইলাস্টিগার্ল আর ফ্রোজোনের দুর্দান্ত অভিযানে জড়িয়ে পড়েছিল দুই ছোট্ট সুপারহিরো ভাই-বোন ড্যাশ আর ভায়োলেটও। চরিত্রগুলোকে আপন করে নিতে একটুও সময় লাগেনি কারো। ফলে বিরাট সাফল্য বয়ে এনেছিল মুভিটি, আয় করেছিল ৬৩৩ মিলিয়ন ডলার।

হলিউডে এখন নিঃসন্দেহে সুপারহিরোদের স্বর্ণযুগ চলছে। তবে এতসব চোখধাঁধানো সিজিআই ইফেক্ট কিংবা টুইস্টওয়ালা কাহিনীর ভিড়েও যে ইনক্রেডিবল পরিবারের আবেদন একটুও কমেনি, তাই প্রমাণ করে দিলো দ্য ইনক্রেডিবলস ২। কারণ দ্য ইনক্রেডিবলসের কাহিনী কেবল হিরো-ভিলেনের অ্যাকশনের ওপরে ভর করে এগোয়নি। মুভির প্রধান বিনোদনকে ঘিরে ছিল বব পার, হেলেন পার আর তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের পারিবারিক খুনসুটি। আর ফ্যামিলি ড্রামার আবেদন কখনোই পুরোনো হবার নয়। সেই সাথে লুসিয়াস কিংবা এডনা মোডের মতোই পার্শ্বচরিত্রগুলোও দারুণ বিনোদন যুগিয়েছিল। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর অপেক্ষার অবসান ঘটানো এই মুভিটি কীভাবে আবারো মন জয় করে নিলো সবার, তা নিয়েই আমাদের আজকের এই লেখা।

ইনক্রেডিবল পরিবার; 2018 – Disney/Pixar

ইনক্রেডিবলস ২ এর কাহিনী শুরু হয় প্রথম মুভিটি যেখান থেকে শেষ হয়েছিল, ঠিক সেখান থেকেই। হাস্যকর নামওয়ালা ভিলেন ‘আন্ডারমাইনার’ মেট্রোভিল শহর আক্রমণ করে ব্যাংকে লুটতরাজ চালাতে থাকে। নানা উপায়ে ইনক্রেডিবল পরিবারের দলগত প্রচেষ্টায় অবশেষে ধরা পড়ে সে। কিন্তু ইতিমধ্যেই সুপারহিরোদের প্রতি কিছুটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করা মানুষজন শহরের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের বোঝা চাপিয়ে দেয় তাদেরই ঘাড়ে। অনেকটা ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ারের সোকোভিয়া অ্যাকর্ডের মতোই সুপারহিরোদের বিরুদ্ধে একটি অ্যাকর্ড ঘোষণা হয়।

ইভিলিন এবং উইনস্টন ডেভর; © 2018 – Disney/Pixar

এমন পরিস্থিতিতে আবির্ভাব ঘটে স্টিভ জবস ধাঁচের টেক-বিলিয়নিয়ার উইনস্টন ডেভরের। সে আর তার বোন ইভিলিন মিলে দাঁড়া করিয়েছে ডেভটেক নামের বিশ্বের একটি সেরা টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিকে। মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ উইনস্টন আর টেকনোলজি বিশারদ ইভিলিন নানা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে সুপারহিরোদেরকে মানুষের সামনে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মিশনে নামে। কিন্তু বিপত্তি আসে তখনই, যখন উইনস্টন জানায় যে মিসেস ইনক্রেডিবল ওরফে হেলেন পারকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।

ফ্রোজোনের সাথে ড্যাশ এবং ভায়োলেট; © 2018 – Disney/Pixar

অগত্যা কী আর করা, মিস্টার ইনক্রেডিবলের ঘাড়ে চাপে দুই দুরন্ত টিনেজ সন্তান সাথে অবোধ শিশু জ্যাক-জ্যাককে সামলানোর দায়িত্ব। নিউ আরডেম শহরে আক্রমণ করে এক মেগাভিলেন স্ক্রিনস্লেভারকে সামলানোর দায়িত্ব চাপে ইলাস্টিগার্লের কাঁধে। এদিকে জ্যাক-জ্যাক দেখানো শুরু করে তার পাওয়ারের খেল। একদিকে সংসারের নানা ঝামেলা, আরেকদিকে জ্যাক-জ্যাকের অপ্রতিরোধ্য এবং অনিয়ন্ত্রিত পাওয়ার, বব একেবারে হেস্তনেস্ত হয়ে যায়। অবশেষে শরণাপন্ন হয় তাদের পরিচিত বিজ্ঞানী বন্ধু এডনা মোডের। বিপদ কিন্তু সবে শুরু, মুহুর্মুহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে থাকে ইনক্রেডিবলেরা সবাই।

এরকমই দুর্দান্ত এক কাহিনী নিয়েই এগিয়ে গিয়েছে এ মুভির প্লট। অনবদ্য এই মজার সিক্যুয়েলটি স্মরণীয় চরিত্রগুলোর প্রতি শতভাগ সুবিচার করেছে। যদি এখনো না দেখে থাকেন, তবে অতি অবশ্যই সময় করে দেখে ফেলতে পারেন। সুপারহিরো হয়েও অতি আপন এই চরিত্রগুলো যে আপনার হৃদয় কেড়ে নেবে, সেটা হলফ করেই বলা যায়।

দুই মুভির গ্রাফিক্সের তুলনা; ©Disney/Pixar

প্রথম মুভিটি দিয়ে ছক্কা হাঁকানোর পরেও দ্বিতীয় মুভিটির আগে এত সময় নেবার জন্য পরিচালক ব্র্যাড বার্ডের ওপরে অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। এর মাঝে তিনি আরেকটি দারুণ অ্যানিমেশন র‍্যাটাটুলি উপহার দিয়েছেন। তবে অপেক্ষার ফল মিষ্টিই হয়েছে, কেননা ইতিমধ্যেই থ্রিডি অ্যানিমেশন প্রযুক্তিতে এসে গেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। অ্যানিমেশনের ধাঁচ একই আছে, তবে প্রথম আর দ্বিতীয় মুভির গ্রাফিক্সের তফাত এক দেখাতেই নজরে আসে। মনোমুগ্ধকর অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলোর পাশাপাশি হাস্যরসাত্মক ডায়লগ কাহিনীকে করেছে গতিশীল, কোনোখানেই একঘেয়ে লাগার সুযোগ নেই। ব্র্যাড বার্ডের ট্রেডমার্ক থ্রি পয়েন্ট শটও চোখ জুড়িয়ে দিয়েছে।

বাবা-মায়ের ভিন্নধর্মী ভূমিকা, © 2018 – Disney/Pixar

মুভির সেরা মুহূর্তলোর কথা বলতে গেলে জ্যাক-জ্যাকের কথা বলতেই হবে। প্রথম মুভিতে হালকা পাতলা আভাস পাওয়া গিয়েছিল, তবে এখানে আক্ষরিক অর্থেই তার ক্ষমতার বিস্ফোরণ ঘটেছে। না বুঝেই নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ফেলা জ্যাক-জ্যাকের সাথে তার বাবার রসায়ন ছিল মুভির হাইলাইট। মাঝবয়সে চাকরি হারিয়ে সংসার সামলাতে বসা বাবা আর কর্মজীবী মায়ের কাহিনীও বলা যায় একে। এই মজার রোল রিভার্সালের মাধ্যমে চাকরিজীবী বাবা আর সংসার সামলানো মায়ের প্রচলিত স্টেরিওটাইপ ভেঙে দিয়েছে ইনক্রেডিবলস ২। ডিজনি এই মুভিটি দিয়ে শিশুদের পাশাপাশি তাদের বাবা-মায়েদের সাথেও একাত্মতা দেখাতে পেরেছে, অন্য মুভিগুলোতে যেটা সম্ভব হয়নি।

শক্তিশালী নারী চরিত্রগুলো বেশ ভালোমতোই বিকশিত হয়েছে। কাহিনীর প্রয়োজনেই দুর্দান্ত সব অ্যাকশন সিকোয়েন্স আর প্লটলাইনের অংশ হিসেবে দেখা গেছে ইলাস্টিগার্ল এবং ভায়োলেটকে। বিজ্ঞানী এডনা কিংবা ইভিলিন ডেভরের চরিত্রগুলোও প্রভাব রেখেছে যথেষ্ট। একটি মজার বিষয় হলো, জার্মান-জাপানী বিজ্ঞানী এডনা মোডের কণ্ঠ কিন্তু দিয়েছেন স্বয়ং ব্র্যাড বার্ড নিজেই। আর তার চরিত্রটিকে ডিজাইন করা হয়েছে বিখ্যাত আমেরিকান কস্টিউম ডিজাইনার এডিথ হেডের আদলে।

এডিথ হেড আর এডনা মোড; 2018 – Disney/Pixar

মজার ব্যাপার, ইনক্রেডিবলস ১ এবং ২ এর সাথে রবার্ট রড্রিগেজের স্পাই কিডস ১ এবং ২ এর বেশ কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সবগুলো মুভিতেই বাবা-মায়ের অমতে সুপারহিরো কিড কিংবা স্পাই কিডদেরকে বিভিন্ন দুর্ধর্ষ অভিযানে অংশ নিতে দেখা যায়। অবশ্য তাদের সাহায্য ছাড়া যে ভিলেনদেরকে হারানো কোনো উপায়ও ছিল না, এ কথাও তাদের বাবা-মাদেরকে স্বীকার করে নিতে হয়েছে। তাছাড়া ইনক্রেডিবলস ২ এর ভয়েস রেকগনিশন সফটওয়্যার ব্যবহারের দৃশ্যটিও স্পাই কিডস মুভিটির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

অনেকেরই মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে, বাচ্চাগুলোর কোনো বিশেষ সুপারহিরো নাম নেই কেন? এ ব্যাপারেও কাহিনীকার দারুণ দেখিয়েছেন। ড্যাশ দিয়ে গতি পরিমাপের একক বোঝায়, যেমন ১০০ মিটার ড্যাশ। ব্যাপারটি ড্যাশিয়েল পার ওরফে ড্যাশের ক্ষমতা তীব্র গতির সাথে একেবারে খাপে খাপে মিলে যায়। এদিকে ভায়োলেট পারের ক্ষমতা হলো, শক্তিক্ষেত্র তৈরি করে যেকোনো জায়গা ভেদ করে যাওয়া। দর্শকের চোখে এই ক্ষেত্রকে আলোকতরঙ্গ সংকোচনের কারণে বেগুনী রঙে দেখানো হয়েছে। আর পিচ্চি জ্যাক-জ্যাকের নাম নিশ্চিতভাবেই ‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস’ কথাটি থেকে নেওয়া হয়েছে, তার বিভিন্ন ক্ষমতার ফুলঝুরি দেখানোর জন্য।

রেগে আগুন হওয়া জ্যাক-জ্যাক; 2018 – Disney/Pixar

আধুনিক অ্যানিমেশন আর সমসাময়িক কাহিনী মিলিয়ে দারুণ একটি সামার ব্লকবাস্টার উপহার দিয়েছে ডিজনি/পিক্সার। আর তার ফলাফলও পেয়েছে হাতেনাতেই। সুপারহিরোময় এই গ্রীষ্মে মুক্তি পেয়েও ২০০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের মুভিটি বিশ্বজুড়ে আয় করে নিয়েছে ১২৩২ মিলিয়ন ডলার! এখন পর্যন্ত এটি এই বছরের সর্বোচ্চ আয় করা ছবিগুলোর মধ্যে চতুর্থ, আর সর্বকালের সর্বোচ্চ আয় করা অ্যানিমেশন ছবিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এটি এর পুরোনো ভক্তদের অপেক্ষার হিসাব কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে দিয়েছে। অতিমানববিদ্বেষী পৃথিবীকে ভয়ঙ্কর ভিলেনদের হাত থেকে রক্ষার এই অভিযানের পরবর্তী কিস্তি একটু আগেভাগেই আসুক, এই আশা সকল ভক্তদের। 

আইএমডিবি: ৮/১০

রোটেন টমাটোস: ৯৪%

মেটাক্রিটিক: ৮০

Leave a Reply