ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি: মন ছুঁয়ে যাওয়া এক গতিময় মেলোড্রামা

রেফারি পতাকা নামালেই গর্জে উঠবে ইঞ্জিন, উল্কার বেগে ঘোরা শুরু করবে চাকাগুলো। রেসের মাঠের এই অ্যাড্রেনালিন রাশ রেসারদের আত্মার একটা অংশও যেন কিনে নেয়।

গোলাকার রেসট্র‍্যাকে একসারিতে দাঁড়িয়ে আছে বর্ণিল ঝকঝকে স্পোর্টসকারগুলো। গাড়ির হুইলে চেপে বসেছে ড্রাইভারের আঙুল। দমবন্ধ করে তাকিয়ে আছে হাজারো দর্শক। রেফারি পতাকা নামালেই গর্জে উঠবে ইঞ্জিন, উল্কার বেগে ঘোরা শুরু করবে চাকাগুলো। রেসের মাঠের এই অ্যাড্রেনালিন রাশ রেসারদের আত্মার একটা অংশও যেন কিনে নেয়। কব্জির মোচড়ে প্রবল গতিতে বাঁকগুলো পার হয়ে সবার মন জয় করে নেন দক্ষ খেলোয়াড়েরা। আনাড়ি ড্রাইভারদের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঘটনাগুলো মাঝে মাঝে হরর মুভিকেও হার মানায়।

রেসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে টকটকে লাল ফোর্ড © Twentieth Century Fox

যুগে যুগে যত নতুন প্রযুক্তিই আসুক, বিনোদনের যত নতুন মাধ্যমই আসুক না কেন, গাড়ি রেসের আবেদন ফুরোবে না কখনো। অনবদ্য এই অ্যাড্রেনালিন রাশের স্বাদ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা মানুষকে কাজে লাগিয়েই গড়ে উঠেছে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ভিডিও গেম কিংবা মুভি ফ্র‍্যাঞ্চাইজের বাণিজ্য।

তবে রেসকে দিয়ে নিজেদের ব্যবসাকে শীর্ষে তুলে নেবার প্রতিযোগিতা মূলত গাড়ি কোম্পানিগুলোর মাঝেই চলে। ট্র‍্যাকে কোন গাড়ির পারফরম্যান্স কেমন, তার ওপরেই নির্ভর করে কর্পোরেট মুঘলদের মান-সম্মান। সত্যিকারে ঘটে যাওয়া এরকম এক ঠাণ্ডা-যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই জমে উঠেছে এ বছরের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি‘। টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস অফ ডেয়টোনা, টুয়েলভ আওয়ারস অফ সিবরিং এনডুরেন্স রেস দেখানো হলেও মুভির মূল আকর্ষণ ছিল ‘লে মাঁ ১৯৬৬’ নামের বিখ্যাত রেসটি। আমেরিকার বাইরে বিভিন্ন দেশে এই নামেই মুভিটি রিলিজ পেয়েছে।

ক্যারল শেলবি ও কেন মাইলসের ভূমিকায় ম্যাট ডেমন ও ক্রিশ্চিয়ান বেল © Twentieth Century Fox

কাহিনীর প্রেক্ষাপট ষাটের দশক। তাই বলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন না যেন, সেটা ছিল অটোমোবাইল শিল্পের জন্য এক বৈপ্লবিক সময়। হেনরি ফোর্ডের হাত ধরে গড়ে ওঠা বিশ্বের সর্ববৃহৎ মোটর কোম্পানি ফোর্ড কিছুটা পিছিয়ে পড়ছিল কেন যেন। মার্সিডিজ, টয়োটা কিংবা নামজাদা আরও সব গাড়ি তখন বাজার দখল করে নিচ্ছে। রেসের মাঠ মাতানো ফেরারি গাড়িগুলোকে দেখে আগ্রহী হয়ে ফেরারি কোম্পানি কিনে নেবার পরিকল্পনা করলেন ফোর্ডের নাতি, হেনরি ফোর্ড দ্য সেকেন্ড। কিন্তু ফোর্ডের গাড়িগুলোকে দেখে নাক সিঁটকালেন ফেরারির ইতালিয়ান মালিক। এরকম কুৎসিত  গাড়ি বানায় যে কোম্পানি, তাদের সাথে জীবনেও চুক্তি করবেন না তিনি। ফলে জিদ চেপে গেল ফোর্ডের, ফেরারির ওপর প্রতিশোধ নেবার একটাই উপায় আছে, রেসট্র্যাকে ওদেরকে হারিয়ে ওদের নাক ভোঁতা করে দেয়া।

ফোর্ড গাড়িগুলোকে রেসের মাঠজয় করার দায়িত্ব এসে পড়ে মোটর ইঞ্জিনিয়ার ক্যারল শেলবির কাঁধে। শেলবি নিজেও ড্রাইভার ছিলেন আগে, কিন্তু সেই সত্ত্বাকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন হার্ট কন্ডিশনের কারণে। তার মনে পড়লো পুরনো বন্ধু, আরেক প্রাক্তন রেসার কেন মাইলসের কথা। কিছুটা রগচটা আর একগুঁয়ে হলেও মোটরগাড়ির ব্যাপারে মাইলসের অসামান্য জ্ঞান। রেসকার ড্রাইভার হিসেবে ব্রিটিশ মাইলসের নামটাও বেশ মানানসই!

কেন মাইলস ও তার ছেলের ভূমিকায় ক্রিশ্চিয়ান বেল ও নোয়া জুপে © Twentieth Century Fox

মাইলসকে কিন্তু সুনজরে দেখতেন না ফোর্ডের মালিকপক্ষ, মাইলসও তাদের কাছে ফেরত যেতে নারাজ। কিন্তু নিজের মেকানিক ক্যারিয়ারের ভগ্নদশা দেখে আর স্ত্রী-পুত্র এবং শেলবির চাপাচাপিতে আবারো রেসের উত্তেজনাময় জগতে ফেরত এলেন তিনি। দুই বন্ধু মিলে রেসিং টিম বানিয়ে ফোর্ডের কলকব্জা নিয়ে অভিনব উপায়ে গবেষণা শুরু করলেন। তার ফল মিললো কিছুদিন বাদেই। আন্ডারডগ হিসেবে শুরু করেও সবার চক্রান্তকে এড়িয়ে কিছুটা মসৃণ কিছুটা এবড়োখেবড়োভাবে চলতে থাকে তাদের অভিযান।

কাহিনীর মূল প্রেক্ষাপট দুই কর্পোরেট ম্যাগনেটের আত্ম-অহমিকা হলেও কাহিনীর প্রাণ হলো শেলবি আর মাইলসের অনবদ্য বন্ধুত্ব। তাদের সম্পর্কের রাগ, তাপ, অভিমান, ভালোবাসা, আফসোস, আত্মবিশ্বাস কিংবা সামনের দিকে এগিয়ে চলার তাগিদ দর্শক খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পারবেন। রেসের মাঠের বাইরেও অতর্কিতে দুরন্ত গতিতে গাড়ি এমনকি প্লেনও ছুটিয়ে দেয়ার মুহূর্তগুলো হাসি ফুটিয়ে তুলবে।

‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি’ মুভির একটি দৃশ্য © Twentieth Century Fox

ফার্স্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াসের জমানায় মুক্তি পাওয়া রেসনির্ভর মুভিগুলো দর্শকের মনে দাগ কাটতে ব্যর্থ হয় প্রায়ই, সেদিক দিয়েই সবার চেয়ে এগিয়ে গেছে এই মুভিটি। সাম্প্রতিককালের ‘রাশ’ মুভির সাথে তুলনা চলে আসতে পারে এক্ষেত্রে। রন হাওয়ার্ডের সেই মুভির মতোই ট্র্যাজেডি, কমেডি আর অ্যাকশন মিলিয়ে আরো একটা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ড্রামা উপহার পেলাম আমরা। ড্রামাকে গতি দিতে জ্বালানি জুগিয়েছে সংলাপ আর পাল্টা সংলাপ।

– “James Bond does not drive a Ford, sir,”

– “That’s because he’s a degenerate!” 

রেসট্র্যাকে চলছে ফোর্ড জিটিফর্টি © Twentieth Century Fox

বরাবরের মতোই বহুরূপী ক্রিশ্চিয়ান বেল যথারীতি আরো একবার নিজের খেল দেখিয়েছেন। ‘ভাইস’ মুভিতে স্থূলকায় ডিক চেনি থেকে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পরিণত হয়েছেন কৃশকায় কেন মাইলসে। নিজের ব্রিটিশ অ্যাক্সেন্টকে কিছুটা পালটিয়ে গ্রিজ মাখা মলিন চেহারার মাল্টিলেয়ার্ড চরিত্রের সাথে মিশে গেছেন একেবারেই। সত্যিকারের ক্যারল শেলবির সাথে ম্যাট ডেমনের চেহারার খুব একটা মিল না থাকলেও নিজের সহজাত অভিনয় দিয়ে অনায়াসেই তিনি তার চরিত্রে প্রাণ দিয়েছেন। তবে দুই হলিউড তারকা যে দৃশ্যগুলোতে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন, সেসময়েই তাদের চরিত্রগুলো দ্বিগুণ বিকশিত হয়েছে। ‘আউটল্যান্ডার’ সিরিজখ্যাত ক্যাটরিওনা বেলফে আর ‘দ্য পানিশার’ খ্যাত জো বার্নাথাল ছিলেন পার্শ্ব ভূমিকায়। এছাড়াও জশ লুকাস কিংবা জ্যাক ম্যাকমালেনের চরিত্রগুলোও মুভিকে এগিয়ে নিয়েছে দারুণভাবে। 

কান্ট্রি রোড ধরে ধুলা উড়িয়ে ছুটে চলা রেসকারগুলোকে ঘিরে চলা ঘটনাগুলোকে উষ্ণ সিনেমাটোগ্রাফি দিয়ে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক জেমস ম্যানগোল্ড। ‘গার্ল ইন্টেরাপ্টেড’, ‘ওয়াক দ্য লাইন’ এর মতো অস্কার মনোনীত মুভিগুলোর চেয়েও তাকে বেশি পরিচিতি এনে দিয়েছে ২০১৫ সালের আর-রেটেড ‘লোগান’। ২৪ ঘণ্টা ধরে শত ল্যাপ দিয়ে চলা লে মাঁকে ফুটিয়ে তোলার অসাধ্য কাজটিই সম্ভব করেছেন তিনি।

মোলায়েম কিন্তু আচমকা গর্জে ওঠা সাউন্ডট্র্যাকটা মুভির থিমের সাথে আশ্চর্যরকম মানানসই। বিশেষ করস ডেয়টোনা রেসের সময় চলা মিউজিকটা শিহরণ তুলে দিতে বাধ্য। সেই সাথে মুভির সময়কালের সাথে মিলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে ষাটের দশকের দারুণ সব কান্ট্রি সং।

‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি’ মুভির একটি দৃশ্য © Twentieth Century Fox

দুর্ভাগ্যবশত, রেসিং কম্যুনিটির বাইরে কেন মাইলসের অর্জন কিছুটা আড়ালেই রয়ে গেছে। ‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি’ মুভির মাধ্যমে অবশেষে নিজের যোগ্য স্বীকৃতির কিছুটা পেলেন তিনি। মাইলস আর শেলবির যুগ্ম প্রচেষ্টায় ফোর্ড জিতে নিয়েছিল ১৯৬৭, ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ লে মাঁ। তারা দুজনে মিলে পাল্টে দিয়েছেন আমেরিকান রেসিংয়ের ইতিহাস। মোটরস্পোর্টসের জগতে এক প্রভাবশালী কোম্পানি হিসেবে জায়গা করে নেয় এটি। লে মাঁর শতবর্ষের ইতিহাসে ফোর্ড হলো একমাত্র আমেরিকান কোম্পানি, যারা এই শিরোপা জিততে সমর্থ হয়েছে।

বক্স অফিসে মুভিটির আয় ১৭০ মিলিয়ন ডলার। আইএমডিবিতে দর্শকদের ভোটে এর রেটিং ৮.৩/১০, রোটেন টমাটোজে রেটিং ৯২% ফ্রেশ। আসন্ন অস্কারে সেরা চলচ্চিত্রসহ আরো কিছু বিভাগে মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত।

সত্যিকারের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে চলা কাহিনীগুলো নীরস প্রামাণ্যচিত্রে রূপ নেয় অনেক সময়। কিন্তু অভিনয়, পরিচালনা, চিত্রনাট্য এমনভাবে খাপে খাপে মিলে গেছে যে বছরের সবচেয়ে উপভোগ্য মুভিগুলোর তালিকাতেও প্রথমের দিকেই থাকবে ‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি’। গাড়ি নিয়ে আকর্ষণ না থাকলেও মুভিটি তার প্রাণবন্ত গতি দিয়ে মন জয় করে নেবে আপনার।

Leave a Reply