ফার্স্ট রিফর্মড: পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে দার্শনিক প্রতিবাদ

অস্বস্তিকর ক্যারেক্টার স্টাডি, নিশ্চল ক্যামেরাওয়ার্ক, ধূসর কিন্তু মনোমুগ্ধকর সিনেমাটোগ্রাফি আর আবহ সঙ্গীতের অনুপস্থিতি মিলে অভিনব একটি উপহার দিয়েছেন পরিচালক। স্লো বার্ন মুভি হলেও অগ্রাহ্য করার উপায় নেই সেজন্য।
 

“ হতাশা থেকেই সৃষ্টি হয় নিজেকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ পর্যায়”

দার্শনিক টমাস মার্টনের এই উক্তিটি ঘিরেই ধ্বংসবাদের পথে যাওয়া একজন আধ্যাত্মিক মানুষের মনোজগতকে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক/পরিচালক পল শ্রেডার। সেইসাথে ছিল প্রতিভাবান অভিনেতা ইথান হকের অসাধারণ অভিনয়। এই সবকিছু মিলেই গড়ে উঠেছে গত বছরের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘ফার্স্ট রিফর্মড (১০১৮)’।

নিউ ইয়র্কের নিরিবিলি এক এলাকা স্নোব্রিজ। শহরটি এর নামের মতোই বরফের চাদরে ঘেরা। এই শহরতলীর মূল আকর্ষণ হলো ২৫০ বছরের পুরনো ডাচ রিফর্মড গির্জা। বর্তমানে সেই ঐতিহ্যবাহী গির্জার মূল দায়িত্বে আছেন মধ্য চল্লিশ পার করা রেভারেন্ড আর্নস্ট টলার। যিনি নিজের দুঃসহ অতীতকে ভোলার লক্ষ্যে মানুষের কল্যাণে নিজের মনঃপ্রাণ ঢেলে কাজ করে চলেছেন নিয়মিত। আগের জীবনে তিনি ছিলেন মিলিটারি চ্যাপলাইন, প্রভাব খাটিয়ে নিজের ছেলে জোসেফকে পাঠিয়েছিলেন ইরাক যুদ্ধে। জোসেফ আর ফিরে আসেনি। ছেলেকে হারানোর পরে তার সংসারও টেকেনি খুব বেশিদিন।

‘ফার্স্ট রিফর্মড’ মুভির অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি; © A24

আপাতদৃষ্টিতে দেখে স্বাভাবিক মনে হলেও শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি ভেঙেচুরে যাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। রেভারেন্ড হয়েও অ্যালকোহলকে ছাড়তে পারেননি, আবার নিত্যদিনের সঙ্গী জার্নালটিকেও এক বছর পড়ে পুড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করে রেখেছেন। এদিকে শহরের প্রভাবশালী মেগাচার্চের কারণে ফার্স্ট রিফর্মড গির্জা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। একদিন মাইকেল নামে এক উগ্রবাদী পরিবেশকর্মীর সাথে পরিচয় ঘটে তার। কানাডার জেল থেকে সদ্য ছাড়া পাওয়া মাইকেলের মতে, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই। দূষণময় প্রকৃতি নিয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজের সন্তানকে জন্ম দেবার আগ্রহও হারিয়ে গেছে তার। আর সেজন্যই নিজের অনাগত সন্তানকে গর্ভপাত করানোর জন্য স্ত্রী মেরিকে চাপাচাপি করছে সে।

মাইকেলের প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেন না টলার। বরং উল্টো মাইকেলের চিন্তাধারা নাড়িয়ে দেয় তার এতদিনের লালিত বিশ্বাসকে। মেরির স্বার্থে ধ্বংসাত্মক মাইকেলকে সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন টলার। আবিষ্কার করেন, বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে তার শহরকে দূষিত করছে যে কারখানা, তার মালিক এডওয়ার্ড বালগই হলেন ফার্স্ট রিফর্মড চার্চের মূল অর্থদাতা। শহরের মেয়র কিংবা অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছেও পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারটা খুব বেশি গুরুত্ব পায় না। এদিকে তিনি নিজেও মুখোমুখি হয়েছেন প্রাণঘাতী প্রোস্টেট ক্যান্সারের। তার সাথেও হয়তোবা এই পরিবেশ দূষণের সরাসরি কোনো যোগসূত্র আছে, এই উদ্বিগ্নতা এবং অসহায়ত্ব থেকে টলারের মনে জন্ম নেয় ক্ষোভ এবং ধ্বংসবাদ। তবে এই অশুভ সময়ে ম্যারির সান্নিধ্য তাকে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখায়।

‘মেরি’ চরিত্রে অ্যামান্ডা সেফ্রেড; © A24

এর আগে খ্যাতনামা পরিচালক মার্টিন স্করসেসির সাথে ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার (১৯৭৬)’, ‘রেজিং বুল (১৯৮০)’, ‘দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অফ ক্রাইস্ট (১৯৮৮)’ মুভিগুলোতে কাজ করেছেন শ্রেডার। কাকতালীয়ভাবে, স্করসেসির সর্বশেষ মুভি ‘সাইলেন্স(২০১৬)’ এ কাজ না করলেও তার সাথে থিমেটিকভাবে আশ্চর্য রকম মিলে গেছে ‘ফার্স্ট রিফর্মড’। নিজের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে বেঁচে থাকা মানুষেরা যখন জীবনের কষাঘাতে সংশয়ের মুখে পড়ে যান, তখন আসলে পরাজয়টা হয় কার? দুই মুভির ক্ষেত্রেই এরকম দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন দর্শকেরা।

রেভারেন্ড টলারের চরিত্রটি গড়ে তোলার পেছনে পল শ্রেডারকে অনুপ্রাণিত করেছেন ফরাসি লেখক জর্জেস বার্নানোসের ‘দ্য ডায়রি অফ অ্যা কাউন্টি প্রিস্ট’ বইটি। বলতে গেলে তার নিজের পুরো ক্যারিয়ারেরই ছায়া পড়েছে এই অসাধারণ মুভিটিতে। সুইডিশ মাস্টারমাইন্ড ইংমার বারিম্যান তার ‘উইন্টারলাইট (১৯৬৩)’ মুভিতে ধর্মীয় বিশ্বাস, পারলৌকিকতাকে নিয়ে নিরীক্ষা করেছিলেন, ঠিক একই পথে হেঁটেছেন শ্রেডার।

‘ট্যাক্সি ড্রাইভার (১৯৭৬)’ মুভির একটি সরাসরি রেফারেন্সও দিয়েছেন পরিচালক। সেই মুভির মূল চরিত্র ট্র্যাভিস বিকলকে একটি দৃশ্যে পানির সাথে আলকা-সেলজার মেশাতে দেখা যায়। ‘ফার্স্ট রিফর্মড’ মুভিতেও টলারকে ইন্টারনেটে আত্মঘাতী বোমা হামলার ভিডিও দেখতে দেখতে মদের সাথে পেপটো-বিসমল মেশাতে দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এই দৃশ্যের মাধ্যমে আসলে তাদের মানসিক অবস্থা ফুটে উঠেছে। আক্ষরিক অর্থেই তাদের মনোজগতে একধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে, যা সময়ের সাথে সাথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিস্ফোরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ আর ‘ফার্স্ট রিফর্মড’ মুভি দুইটির দৃশ্য; © A24

১.৩৭:১ অনুপাতে নির্মিত মুভিটি প্রথমেই এর বদ্ধ আবহের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। পুরো মুভির মধ্যেই মিনিমালিস্ট ভাব এসে গেছে সেজন্য। ধূসর প্রকৃতি যেন পদে পদে দর্শককে টলার তথা গোটা বিশ্বের মর্মান্তিক পরিণতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। মানসিকভাবে অতলান্তের গভীরে যেতে থাকা যাজক টলারের চরিত্রে ইথান হককে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করা যাচ্ছে না। তার সাথে যোগ্য সাহচর্য দিয়েছেন অ্যামান্ডা সেফ্রেড সহ অন্যান্য অভিনেতারা। অস্বস্তিকর ক্যারেক্টার স্টাডি, নিশ্চল ক্যামেরাওয়ার্ক, ধূসর কিন্তু মনোমুগ্ধকর সিনেমাটোগ্রাফি আর আবহ সঙ্গীতের অনুপস্থিতি মিলে অভিনব একটি উপহার দিয়েছেন পরিচালক। স্লো বার্ন মুভি হলেও অগ্রাহ্য করার উপায় নেই সেজন্য।

মসৃণ গতিতে চলতে চলতে হঠাৎ করেই রেভারেন্ড টলারের দুর্বোধ্য এক পরিণতি দিয়ে শেষ হয় মুভিটি। শ্রেডারের মতে, কিছুটা ওপেন-এন্ডেড রাখার মাধ্যমেই মুভিটি সার্থক হয়েছে। সেজন্য অবশ্য দর্শকদের কাছ থেকে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আবার এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনার পথও উন্মোচিত হয়েছে।

ফার্স্ট রিফর্মড চার্চ ; © A24

সিনেমার শেষ অঙ্কে মরণব্যাধির কারণে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু আর অনিষ্ট থেকে সবাইকে বাঁচানোর আকুতি মিলিয়ে ভয়ানক এক সিদ্ধান্ত নেন টলার। চার্চের জন্মজয়ন্তীর দিনে আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে নিজের সাথে সাথে এলাকার প্রভাবশালী নির্দয় মানুষগুলোকেও শেষ করে দেবার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু বারণ করা সত্ত্বেও চার্চে এসে উপস্থিত হন মেরি। ফলে চমকে উঠে মত পাল্টে ফেলেন তিনি। নিজের গায়ে কাঁটাতার পেঁচিয়ে এই ভয়ানক চিন্তার প্রায়শ্চিত্তই যেন করতে চান। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সকল ইচ্ছা হারিয়ে ফেলায় হাতে তুলে নেন বিষের গ্লাস। সেসময় মেরি এসে ঘরে ঢুকলে বিষের গ্লাস ফেলে প্রবলভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে পড়েন দুইজনে।

এরকম সমাপ্তির দু’ রকম ব্যাখ্যা করা যায়। এক হতে পারে, আমরা যা দেখেছি, তা-ই ঘটেছে। রেভারেন্ড টলার আপাতত হামলার চিন্তা বাদ দিয়েছেন। কিন্তু তাতেই কি হাঁফ ছেড়ে বাঁচার উপায় আছে? তাকে অচিরেই কাবু করে ফেলবে প্রাণঘাতী ক্যান্সার। প্রাণবন্ত শহরটাকে ধীরে ধীরে আরো দূষিত করে তুলবে প্রভাবশালী শিল্পপতির দল।

তবে ঘটনাগুলোকে একটু ভিন্ন চোখেও ভেবে দেখা যায়। পাস্তর জো দরজায় ধাক্কা দিয়েও রেভারেন্ড টলারকে দরজা খোলাতে পারেননি। তাই হঠাৎ করে ঐ ঘরে ম্যারির ঢুকে পড়াটা কিছুটা অসম্ভব ব্যাপার। বারবার ঈশ্বরকে ডেকেও অশুভকে মোকাবেলা করার ব্যাপারে কোনো সদুত্তর পাননি টলার। নরক অনিবার্য জেনেও তাই আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। হয়তো সেজন্যই বোমা হামলায় মৃত্যুর পরে ঈশ্বর তাকে স্বর্গের একটা রূপ দেখিয়ে দিলেন ম্যারির মাধ্যমে।

কাহিনী নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও সমালোচকেরা সাদরে গ্রহণ করেছেন মুভিটিকে। ২২৩টি ভোটের ভিত্তিতে রোটেন টম্যাটোসে ৯২% ফ্রেশ রেটিং পেয়েছে মুভিটি। ন্যাশনাল বোর্ড অফ রিভিউ এবং আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট তাদের বর্ষসেরা দশ চলচ্চিত্রের তালিকায় জায়গা দিয়েছে ফার্স্ট রিফর্মডকে।

‘ফার্স্ট রিফর্মড’ মুভির পোস্টার ; © A24

ইথান হকের ক্যারিয়ার জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ঘরানার অসাধারণ সব চলচ্চিত্র। তার প্রিয় বন্ধু, জনপ্রিয় অভিনেতা নিকোলাস কেজ এই মুভিতে তার পারফরম্যান্সকে ক্যারিয়ারসেরা বলে অভিহিত করেছেন। ভেনিস চলচ্চিত্র পুরস্কার, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইথান হক তার প্রাপ্য অস্কার মনোনয়নটি পাননি। একইভাবে অস্কার কর্তৃপক্ষের অবহেলার শিকার হয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার অ্যালেক্সান্ডার ডাইন্যান। তবে দীর্ঘ ৪৪ বছরের ক্যারিয়ারের প্রথম অস্কার মনোনয়নটি পেয়েছেন পল শ্রেডার। অবশ্য সেরা পরিচালক হিসেবে নয়, সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে।

খুব বেশি রূপকের ব্যবহার নেই, দুর্বোধ্য সংলাপ কিংবা কাহিনীর মারপ্যাঁচও নেই তেমন। তারপরেও দর্শককে গভীরভাবে ভাবার অবকাশ করে দিয়েছে ফার্স্ট রিফর্মড। পৃথিবীর অন্তিমকালকে খুব দ্রুতই ডেকে আনছে স্বার্থপর মানুষেরা। আসন্ন এই বিপর্যয় থেকে মুক্তির পথ হয়তো আমাদের সামনেই আছে, কিংবা নেই। তারপরেও মানুষের অস্তিত্ববাদকে দ্বিধায় ফেলে দেবার জন্য এধরনের চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের প্রয়োজন আছে।

Leave a Reply