সোনালী যুগের প্রতিনিধি কার্ক ডগলাস

অভিনয়ে নিজের সেরা সময় পার করে আসার পর বেশিরভাগ অভিনেতাই যেখানে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন, কার্ক ছিলেন সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

নিউ ইয়র্কের মন্টোগোমারি কাউন্টির এক এঁদো গলিতে বাস করতেন রাশিয়ান অভিবাসী বার্থা/হ্যারি দম্পতি। প্রবল শীতের এক রাতে তাদের ঘর আলো করে জন্ম নিলো এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান। ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখে জন্ম নেয়া ইশার ড্যানিয়েলোভিচ ডেমস্কি যে ভবিষ্যতে হলিউডের একজন কিংবদন্তী অভিনেতায় পরিণত হবেন, সেটা হয়তো সুদূর কল্পনাতেও ভাবতে পারেননি তারা।

নিজের পৌরুষদীপ্ত চেহারা এবং সহজাত অভিনয় প্রতিভা দিয়ে ষাট এবং সত্তরের দশকে পর্দা কাঁপিয়েছেন একের পর এক কালজয়ী চলচ্চিত্র দিয়ে। বিপ্লবী ক্রীতদাস, নির্দয় কাউবয়, খামখেয়ালী চিত্রশিল্পী, হতাশ চিত্রপরিচালক, সেনাবাহিনীর একনিষ্ঠ সৈনিকের মতো বিচিত্র সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনায়াসে। 

কার্ক ডগলাস; Image Source: miifotos.com

বলছিলাম হলিউডের সোনালী যুগের বেঁচে থাকা একমাত্র প্রতিনিধি কার্ক ডগলাসের কথা। এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন। চলুন আবার ফিরে যাই তার শিশুবেলায়।

ছয় বোনের সাথে ইশার ওরফে কার্ক বেড়ে উঠছিলেন প্রবল অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। কয়েকটা পেনি আয়ের জন্য ঈগল স্ট্রিটের রাস্তায় ন্যাকড়া, ধাতুর টুকরো কুড়িয়ে বেড়াতেন তার বাবা হ্যারি। রাশিয়ায় থাকতে ঘোড়ার ব্যবসা করা হ্যারি কোনোভাবেই সংসার চালাতে পারছিলেন না।

পরিবারের রুটি-রুজির যোগান দেবার জন্য শিশু বয়সেই মিল শ্রমিকদের কাছে খাবার পৌঁছে দেবার কাজ করতেন তিনি। কিছুদিন পরেই শুরু করেন খবরের কাগজ পৌঁছে দেবার কাজ। পুরোদস্তুর অভিনেতা হবার আগে কম করে হলেও এরকম ছোটখাট চল্লিশ ধরনের পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। অবশ্য অভিনয়ের নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল সেই হাই স্কুলে থাকতেই। স্কুলের নাটকগুলোতে অংশ নেবার সময়েই নিজের এই সুপ্ত প্রতিভা টের পান তিনি। শুধু তা-ই নয়, সেন্ট লরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে পেশাদার রেসলিংয়ের সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি। পরে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্টস থেকে বৃত্তি পেয়ে যান তিনি। সেখানে অভিনয়ের কোর্স করার সময়ে তার জীবনের মোড় পাল্টে যায়। পরিচিত হন লরেন বেকলের সাথে, যিনি পরবর্তীতে তার ক্যারিয়ারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছেন। তার আরেক সহপাঠী ছিলেন ডায়ানা ডিল, যিনি ছিলেন তার প্রথম স্ত্রী।

১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউএস নেভিতে যোগ দিতে গিয়ে অবশেষে নিজের পিতৃপ্রদত্ত নামটি পাল্টে ফেলেন তিনি। এয়ার ফোর্সে যোগ দেবার ইচ্ছা থাকলেও বয়সের কারণে আর হয়ে ওঠেনি সেটা। নেভিতে তিনি চাকরি করতেন গানারি অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার হিসেবে। সেখানে চাকরিরত অবস্থাতেই ১৯৪৩ সালে তিনি বিয়ে করেন ডায়ানাকে। ১৯৪৪ সালে এক সাবমেরিন দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি, সেই কারণে নেভি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় তাকে। সেই বছরেই জন্ম নেন তাদের প্রথম সন্তান, জনপ্রিয় অভিনেতা মাইকেল ডগলাস।

শিশু মাইকেলের সাথে কার্ক; Image Source: Hulton Archive/Getty Images

যুদ্ধ থেকে ফিরে নিউ ইয়র্কের রেডিও এবং থিয়েটারগুলোর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সংসার চালানোর খাতিরে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছিলেন সেসময়। প্রথমে কিছু ছোটখাট চরিত্র করলেও ‘কিস অ্যান্ড টেল’ নাটকের প্রধান চরিত্র করার মাধ্যমে আস্তে আস্তে থিয়েটারে সাফল্য পেতে শুরু করেন। সেসময় পর্যন্তও বড় পর্দায় কাজ করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তার। হঠাৎ করেই এগিয়ে আসেন তার পুরনো বন্ধু লরেন বেকল, কার্কের ওপর সবসময়েই একটু দুর্বলতা ছিল তার। লরেন তার প্রযোজক বন্ধু হ্যাল বি. ওয়ালিসের সাথে কার্কের পরিচয় করিয়ে দেন। এভাবেই সূচনা হলো কার্কের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের।

কার্ক ডগলাস এবং লরেন বেকল; Image Source: Universal Pictures

লরেন এবং কার্ক একত্রে অভিনয় করেছিলেন ‘ইয়ং ম্যান উইথ অ্যা হর্ন (১৯৫০)’ এবং ‘ডায়মন্ডস (২০০৯)’ মুভিতে। লরেন বেকলের সাথে কার্কের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর থেকেও একটু বেশি গাঢ়। ১৭ বছর বয়সে যখন তাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল, কার্কের তখন নিজের জন্য একটা নতুন কোট কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাকে শীতে কষ্ট পেতে দেখে নিজের চাচার কাছ থেকে দুটো নতুন কোট এনে দিয়েছিলেন লরেন। কেবল কার্ককে দেখার জন্যই তিনি যে হোটেলে কাজ করতেন, সেখানে বারবার ছুটে যেতেন তিনি। কার্কের সাথে একত্রে অভিনয়র স্বপ্নও দেখতেন তিনি। কিন্তু দুজনের আট বছর বয়সের ফারাকের কারণেই কি না কে জানে, তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা প্রেম পর্যন্ত গড়ায়নি। কার্ক অবশ্য সবসময়েই তাকে নিজের জন্য লাকি চার্ম হিসেবে বিবেচনা করতেন।

২০০৯ সালে তার হাতে সম্মানসূচক অস্কার তুলে দিয়েছিলেন কার্ক। সেসময় তিনি বলেছিলেন, “লরেনের মুখের ঝাঁঝ একটু বেশি থাকলেও ওর অন্তরটা একদম নিখাঁদ সোনা দিয়ে তৈরি।”

বারবারা স্ট্যানউইকের বিপরীতে ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ লাভ অফ মার্থা আইভারস’ দিয়ে বড় পর্দায় যাত্রা শুরু করেন কার্ক ডগলাস। তার স্বভাবজাত অভিনয় প্রতিভা দেখে দর্শক-সমালোচকেরা ভূয়সী প্রশংসা করা শুরু করেন।

১৯৪৭ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘আই ওয়াক অ্যালোন’ নামক ড্রামা মুভিতে। সেখানে তার সহ-অভিনেতা ছিলেন আরেক কিংবদন্তী বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার। মুভিটি খুব অসাধারণ না হলেও তাদের দুজনের দুর্দান্ত রসায়ন নজর কাড়ে সবার। পরে তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চল্লিশ বছরে আরো ছয় ছয়টি মুভি করেন ল্যাঙ্কাস্টারের সাথে। সেগুলোর মধ্যে ছিল- কমেডি ‘দ্য ডেভিল’স ডিসিপল (১৯৫৯)’, ওয়েস্টার্ন ‘গানফাইট অ্যাট দ্য ওকে কোরাল (১৯৫৭)’, পলিটিক্যাল থ্রিলার ‘সেভেন ডেজ ইন মে (১৯৬৪)’, গ্যাংস্টার কমেডি ‘টাফ গাইজ (১৯৮৬)’ ইত্যাদি।

প্রিয় বন্ধুর সাথে ‘সেভেন ডেজ ইন মে’ মুভিতে কার্ক; Image Source: Joel Productions

একবার নিজের এই প্রিয় বন্ধুর সম্পর্কে কার্ক বলেছিলেন,

অবশেষে বার্টের সাথে জুটি বাঁধা বন্ধ হয়েছে, এবার হয়তো সুন্দরী নায়িকাদের সাথে জুটি বাঁধতে পারব।

বেশ কিছু ছবিতে কাজ করলেও নিজের মনমতো চরিত্র পাচ্ছিলেন না কার্ক। ১৯৪৭ সালে জন্ম নেন ডায়ানা/কার্ক দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান জোয়েল। অবশেষে ১৯৪৯ সালের ‘চ্যাম্পিয়ন’ চলচ্চিত্রে বক্সারের চরিত্র দিয়ে নিজের প্রথম অস্কার মনোনয়ন অর্জন করেন তিনি। খুব বেশি ব্যবসাসফল না হওয়া চলচ্চিত্রটি অস্কারে মোট ছয়টি মনোনয়ন পায়। তবে ‘চ্যাম্পিয়ন’ এ কাজ করার জন্য মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের বিগ বাজেট মুভি ‘দ্য গ্রেট সিনার’ এ অভিনয়ের লোভনীয় প্রস্তাব হাতছাড়া করতে হয়েছিল তাকে।

১৯৫২ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য বিউটিফুল’ চলচ্চিত্রে। হলিউডের বর্ণিল জগতের আড়ালে থাকা হতাশ কিছু মানুষকে ঘিরে নির্মিত এই মেলোড্রামাটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়। একাকিত্ব ভোগা হলিউডের এক প্রযোজকের ভূমিকায় অভিনয় করে কার্ক পেয়ে যান ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অস্কার মনোনয়ন। পাঁচটি বিভাগে অস্কার জিতে নেয় মুভিটি।

১৯৫৪ সালে কার্ক বিয়ে করেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যান ডগলাসকে। মাত্র কিছুদিন আগেই তার সাথে নিজের ৬৪তম বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করলেন তিনি। ১৯৫৬ সালের ‘লাস্ট ফর লাইফ’ মুভিতে খ্যাতনামা ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। কাহিনী সাদামাটা হলেও ভ্যানগগের খামখেয়ালী চরিত্রের এক অসাধারণ প্রতিকৃতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় মুভিটিকে।

কার্ক ডগলাস এবং ভ্যান গগের আত্মপ্রতিকৃতি; Image Source: Metro-Goldwyn-Mayer

কার্কের অভিনয় সম্পর্কে সমালোচক জন ম্যাককার্টেন বলেছিলেন,

‘লাস্ট অফ লাইফ’ হয়তো কাহিনীগতভাবে ভ্যান গগের মানসিক অবস্থার গভীরে যেতে পারেনি। কিন্তু লালচে চুল-দাঁড়ির আড়ালে থাকা কার্ক কিন্তু ভ্যান গগের আত্মপ্রতিকৃতির সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে গিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল, আলো-ছায়ার এ পৃথিবীকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার সংগ্রামে থাকা শিল্পী আসলেই রূপালী পর্দায় উঠে এসেছেন।

অনবদ্য অভিনয়ের জন্য কার্ক জিতে নেন গোল্ডেন গোব, অস্কারেও বাগিয়ে নেন আরেকটি মনোনয়ন।

১৯৫৫ সালে তিনি চালু করেন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ব্রাইনা প্রডাকশনস। সেখান থেকেই মুক্তি পায় তার ক্যারিয়ারের সেরা দুই চলচ্চিত্র। প্রথমটি ছিল ঐতিহাসিক ওয়ার ড্রামা ‘পাথস অফ গ্লোরি (১৯৫৭)’, আর দ্বিতীয়টি ছিল ‘স্পার্টাকাস (১৯৬০)’। দুটি চলচ্চিত্রেরই পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্ট্যানলি কুবরিক। 

‘পাথস অফ গ্লোরি’ প্রচলিত আর দশটি যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র থেকে আলাদা, বরং একে যুদ্ধবিরোধী হিসেবেই অভিহিত করা হয় সবসময়। সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত মুভিটির কাহিনী ছিল মূলত এক কোর্ট মাশালকে কেন্দ্র করে। এক দুর্নীতিবাজ জেনারেল প্রমোশোনের লোভে নিজের সৈন্যদেরকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেন। অসম্ভব এই মিশনে নিহত হন অনেকে। আর যারা তার আদেশ অমান্য করেছিলেন, তাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। সেই হতভাগা সৈন্যদের পক্ষ নেয়া কর্নেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন কার্ক। সে সময়ে এরকম কাহিনী পর্দায় তুলে আনা ছিল একটা দুঃসাহসিক ব্যাপার, কিন্তু কুবরিক এবং ডগলাস কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করেননি।

রোমান সাম্রাজ্যের ভিত নড়িয়ে দেয়া বিপ্লবী স্পার্টাকাসের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন তিনি। অন্যান্য গ্ল্যাডিয়েটর এবং ক্রীতদাসদের একত্র করে পাহাড়ের গভীরে সেনাবাহিনী গঠন কিংবা পদাতিক রোমান সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি যুদ্ধে বারবার হারিয়ে দেবার এই রোমাঞ্চকর অনবদ্য কাহিনী সবার কাছে নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘স্পার্টাকাস’ এ অভিনয়ের পর থেকে মানুষ কার্ক ডগলাসকে একনামে চেনা শুরু করে।

স্পার্টাকাসের ভূমিকায় কার্ক; Image Source: Bryna Productions

ষাটের দশকজুড়ে একের পর এক উপহার দেয়া অব্যাহত রাখেন তিনি। ওয়েস্টার্ন ড্রামা ‘লোনলি আর দ্য ব্রেভ (১৯৬২)’ মুভিতে আধুনিক বিপ্লবী, পলিটিক্যাল থ্রিলার ‘সেভেন ডেজ ইন মে’ মুভিতে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ফোর্স জেনারেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধভিত্তিক ‘ইন হার্মস ওয়ে (১৯৬৫)’ মুভিতে নাভাল অফিসার, ওয়ার ড্রামা ‘ক্যাস্ট অ্যা জায়ান্ট শ্যাডো (১৯৬৬)’ মুভিতে ইসরায়েলপন্থী আর্মি অফিসার, ওয়েস্টার্ন কমেডি ‘দ্য ওয়ার ওয়াগন (১৯৬৭)’ মুভিতে প্রতিশোধের নেশায় থাকা এক কাউবয়, ড্রামা ‘দ্য অ্যারেঞ্জমেন্ট’ মুভিতে অসুখী এক্সিকিউটিভ- এরকম দুর্দান্ত কিছু চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

১৯৬৩ সালে কেন কেসির খ্যাতনামা উপন্যাস ‘ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্য কুক্কু’স নেস্ট’ উপন্যাসটি বড় পর্দায় আনার পরিকল্পনা করেন কার্ক। কিন্তু এই উপন্যাসের জটিল চিত্রনাট্যকে দর্শকের কাছে উপস্থাপনের অনুপযোগী বলে মনে হয়েছিল হলিউডের সব স্টুডিওর কাছেই। তবে এই উপন্যাসের স্বত্ত্ব কিন্তু ডগলাস পরিবারের কাছেই ছিল। পরবর্তীতে তার ছেলে মাইকেল ডগলাসের সহ-প্রযোজনায় ১৯৭৫ সালে নির্মিত হয় এই মুভি। মুক্তি পাবার পর সাড়া ফেলে দেয়া মুভিটি মূল পাঁচটি বিভাগে (সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী, সেরা চিত্রনাট্য) অস্কার জিতে নিয়ে রেকর্ড গড়ে। জ্যাক নিকলসন অভিনীত চলচ্চিত্রটিকে অনেকেই সর্বকালের সেরার তালিকায় স্থান দিয়েছেন।

দুর্ভাগ্যবশত, সত্তরের দশকের তার ক্যারিয়ারে কিছুটা ভাটা পড়ে। ১৯৭০ সালে হেনরি ফন্ডার সাথে করা ওয়েস্টার্ন ‘দেয়ার ওয়াজ অ্যা ক্রকেড ম্যান’ খুব বেশি সফলতা পায়নি। তার পছন্দের জনরা ওয়েস্টার্নে ফিরে আসেন ‘দ্য ভিলেন (১৯৭৯)’ দিয়ে, সেটি আবার ছিল আরনল্ড শোয়ার্জনেয়ারের ক্যারিয়ারের প্রথম দিককার ছবি। এছাড়াও তার অভিনীত বিভিন্ন মুভির মধ্যে ছিল- ব্রায়ান ডি পালমা পরিচালিত হরর ‘দ্য ফিউরি (১৯৭৮), সাই-ফাই থ্রিলার ‘স্যাটার্ন থ্রি (১৯৮০)’ অপেরা ড্রামা ‘দ্য ম্যান ফ্রম স্নোয়ি রিভার (১৯৮২)’ ইত্যাদি।

১৯৭৩ সালে পরিচালনা শুরু করেন ‘স্ক্যালাওয়াগ’ মুভিটির মাধ্যমে। এরপর ‘পোসে (১৯৭৫)’ মুভিটির জন্য আরো একবার পরিচালকের চেয়ারে বসেন তিনি। ‘স্ক্যালাওয়াগ’ মুভিতে প্রযোজকের ভূমিকায় ছিলেন অ্যান ডগলাস। সে প্রসঙ্গে কার্ক বলেছিলেন, “যে নারীকে একদিন চাকরি দিয়েছিলাম, আজ তার অধীনেই কাজ করতে হচ্ছে আমাকে !” 

১৯৮৬ সালে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালে তার অভিনীত টিভি মুভি ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’ দুই বিভাগে এমি পায়। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘দ্য র‍্যাগম্যান’স সন’। বইয়ের একটি লাইন ছিল এমন,

অভাবে জর্জর এক পরিবারের ছেলে সুযোগ পেয়ে গেছে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের সাথে সকালের নাশতা করার, যে প্রেসিডেন্ট কি না নিজেই কৃষক ছিলেন একসময়ে।

এছাড়াও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পাশাপাশি তার জীবনের বিভিন্ন প্রেমের ইতিহাসও উঠে এসেছিল সেখানে।  সেই বছরের বেস্ট সেলিং উপন্যাসের তালিকায় উঠে যায় বইটি। 

১৯৯১ সালে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় কোমর ভেঙে মরমর দশা হয়েছিল তার। অবশ্য বিশ্রাম নিয়ে ঠিকই নিজের কর্মজীবনে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৯২ সালে এইচবিওর হরর সিরিজ ‘টেলস ফ্রম দ্য ক্রিপ্ট’ এর জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে এমি মনোনয়ন পান তিনি।

মাইকেল এবং কার্ক ডগলাস; Image Source: Fred Sabine/NBCU Photo Bank

১৯৯৬ সালে স্ট্রোক হয় তার। এর ফলে বাকশক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলেন তিনি। দরাজ গলায় সংলাপ বলা মানুষটি ভেবেছিলেন, আর কখনো এই জগতে ফিরতে পারবেন না। কিন্তু স্বজন এবং বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় ভয়েস থেরাপিস্টের সাথে কাজ করা শুরু করেন তিনি। সেই বছরেই তাকে সম্মানসূচক অস্কার প্রদান করা হয়। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জ্যাক ভ্যালেন্তি তাকে বলেছিলেন, ছোট করে একটা ধন্যবাদ দিতে। কিন্তু অস্কারের মঞ্চে হাজারো দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পান কার্ক। সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি নিজের স্ত্রী=পুত্রকে নিয়েও বেশ কিছু কথা বলে উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দেন তিনি। সে প্রসঙ্গে ভ্যালেন্তি পরে বলেছিলেন,

কার্কের ভাষ্য শেষ হবার পরে সবার করতালিতে লস অ্যাঞ্জেলসের হলঘরটা যেন ফেটে পড়েছিল। মৃত্যমুখ থেকে ফিরে আসা এবং বাকশক্তিকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কাকে কাটিয়ে ওঠা এই কিংবদন্তীর প্রতি সবার আবেগ যেন গর্জিয়ে উঠেছিল ঐদিন।

২০০৩ সালে তার দুই ছেলে মাইকেল এবং জোয়েল ডগলাসের প্রযোজনায় নির্মিত হয় ‘ইট রানস ইন দ্য ফ্যামিলি’ মুভিটি। কার্ক সেখানে স্ট্রোকে ভোগা এক হতাশ ধনকুবেরের ভূমিকায় অভিনয় করেন, কিছুটা নিজের জীবনের আদলেই। সেখানে কার্কের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন তার প্রথম স্ত্রী ডায়ানা ডিল, সেই ১৯৫৪ সালে ছাড়াছাড়ি হবার পরেও তাদের মধ্যে সবসময়েই সুসম্পর্ক বজায় ছিল। এছাড়াও এই মুভিতে মাইকেল এবং মাইকেলের ছেলে ক্যামেরন ডগলাসও অভিনয় করেন। কাহিনী কিছুটা খাপছাড়া হলেও ক্যাস্টিং এর জোরে কমেডি ড্রামাটি ভালোই সাড়া ফেলেছিল।

২০০৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার কালভার সিটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় কার্ক ডগলাস থিয়েটার। সেখানে ২০০৯ সালে ‘বিফোর আই ফরগেট’ নামক আত্মজীবনীমূলক একক নাটকে অভিনয় করেন তিনি।

১০১ বছর বয়সে পুত্রবধূ ব্রিটিশ অভিনেত্রী ক্যাথেরিন জেটা জোনসের সাথে ৭৫তম গোল্ডেন গ্লোব অনুষ্ঠানে সেরা চিত্রনাট্য বিভাগের পুরষ্কার হস্তান্তর করেন তিনি। উপস্থিত সকল দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় এই প্রবীণ অভিনেতাকে।

পুত্রবধূ ক্যাথেরিন জেটা জোনসের সাথে গোল্ডেন গ্লোবে কার্ক ডগলাস ; Image Source: independent.co.uk

সাড়া ফেলে দেয়া ‘দ্য র‍্যাগম্যান’স সন’ ছাড়াও তিনি আরো অনেকগুলো বই লিখেছেন- ‘ড্যান্স উইথ দ্য ডেভিল (১৯৯০)’, ‘দ্য গিফট (১৯৯২)’, ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন ব্রুকলিন (১৯৯৪)’, উপন্যাস ‘দ্য ব্রোকেন মিরর (১৯৯৭), ‘ইয়ং হিরোজ অফ বাইবেল (১৯৯৯), ‘ক্লাইম্বিং দ্য মাউন্টেন (২০০১)’, ‘মাই স্ট্রোক অফ লাক (২০০৩)’, ‘আই অ্যাম স্পার্টাকাস! (২০১২)’। শুনলে আশ্চর্য হবেন, তিনি এই বয়সেও ব্লগিং করেন। তার লেখা নিয়মিত হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়।

জীবনভর নানারকম জনদরদী কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সাল থেকেই তিনি আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর। ১৯৬৪ সালে স্ত্রী অ্যানের সাথে আলোচনা করে নিজেদের দেয়ালে টানানো মহামূল্যবান ছবিগুলো বেচার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরে সেই অর্থে গৃহহীন নারীদের জন্য নির্মিত হয় ‘অ্যান ডগলাস সেন্টার’। অ্যালঝেইমার রোগীদের জন্য নিজের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘হ্যারি’জ হেভেন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্টপন্থী হবার অপরাধে হলিউডের বিভিন্ন অভিনেতা, গায়ক, লেখক, পরিচালককে ব্ল্যাকলিস্টে রেখে তাদের ক্যারিয়ার থমকে দেয়া হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে ব্ল্যাকলিস্টেড লেখক কার্লটন ট্রামবোকে ‘স্পার্টাকাস’ মুভির চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দিয়ে সেই কুখ্যাত নিয়ম ভেঙে ফেলেন কার্ক। নব্বইয়ের দশকের অভিনীত বেশিরভাগ চরিত্রেই বার্ধক্যপীড়িত মানুষের হাহাকার ফুটিয়ে তুলে জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

কার্ক এবং অ্যান ডগলাস ; Image Source: Entertainment Weekly

নিজের কাজের মাধ্যমে নানা অবদান রাখার কারণে সারাজীবনই পেয়েছেন অজস্র পুরষ্কার ও সম্মাননা। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার প্রেসিডেনশিয়াল মেডাল অফ ফ্রিডম (১৯৮১), জেফারসন অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৩), আমেরিকান সিনেমা অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৩), জার্মান গোল্ডেন কামেরা অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৯), দ্য ন্যাশনাল বোর্ড অফ রিভিউ ক্যারিয়ার অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ১৯৮৯), সম্মানসূচক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৫), আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে পেয়েছেন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৯)। ফরাসি সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার। এছাড়াও ইতালি, পর্তুগাল, জার্মানি, ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

সারাজীবনই উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেছেন কার্ক। সেনাবাহিনীর জীবন থেকে এসেছেন রূপালী পর্দায়, পরবর্তীতে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন পর্দার পেছনের নানা ক্ষেত্রেও। অভিনয়ে নিজের সেরা সময় পার করে আসার পর বেশিরভাগ অভিনেতাই যেখানে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন, কার্ক ছিলেন সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। স্রষ্টার কৃপার পাশাপাশি নিজের এই ইতিবাচক মানসিকতাই হয়তো তাকে শতবর্ষী হবার পরেও দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটার শক্তি যোগাচ্ছে। শুধু রূপালী পর্দার শক্তিশালী চরিত্রগুলোর জন্য নয়, নিজের অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের কারণেও তিনি সবার কাছে যুগে যুগে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Leave a Reply